বিদূষক

কাহিনিসূত্র — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর    

নাট্যসৃজন — সুব্রত নাগ

চরিত্র — বিদূষক (একক নাটক)

 [মঞ্চ অন্ধকার। আবছা আলো ফুটে ওঠে। কারাগারের লোহার গারদের লম্বা ছায়া পড়ে। প্রহরীদের পায়ের ভারি জুতোর মসমস শব্দ শোনা যায়। নীল আলো ফোটে। এক ব্যক্তিকে দর্শক আসনের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার হাতে পায়ে শৃঙ্খল। আবছা আলোয় পিছনের পর্দায় লৌহ শৃঙ্খলের ছায়া পড়ে। প্রহরীদের হাঁক শোনা যায় —হুঁ-শি-য়া-র’- প্রহরীদের জুতোর আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। মঞ্চের আলো কিছুটা উজ্জ্বল হয়। নেপথ্য থেকে শোনা যায় —হি ইজ্ দ্য স্ট্রংগেস্ট ম্যান হু স্ট্যাণ্ডস্ অ্যালোন্; হি ইজ্ দ্য স্ট্রংগেস্ট ম্যান হু স্ট্যাণ্ডস্ অ্যালোন্— শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষটি এই কথাটি বলতে বলতে দর্শকদের দিকে ফেরে।]

[মঞ্চে মাঝারি আলো। লোকটি এগিয়ে আসে।]

লোকটি : বিশ্বাস করেন এ কথা? আপনি? আপনারা? কখনো একা দাঁড়িয়েছেন? সম্পূর্ণ একা? তাল গাছের মতো সবার মাথা ছাপিয়ে কখনো দাঁড়িয়েছেন? কিংবা আকাশছোঁয়া পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসীম এক পাথরের মতো? দাঁড়িয়েছেন? অথবা সফেন অতলান্তিকের বুকে অ্যালবাট্রসের মতো একা উড়ে বেড়িয়েছেন? একা - একা! একা শব্দটার মধ্যেই কী প্রগাঢ় একাকীত্ব জমে রয়েছে, তাই না?

[প্রহরীদের জুতোর আওয়াজ আবার শোনা যায়। তারা হাঁক দেয় — হুঁ-শি-য়া-র।]

আমি দাঁড়িয়েছিলাম একা — মাত্র এক পক্ষ কাল আগে। মাথার উপরে সেদিন বৃষ্টিভেজা আকাশ জুড়ে রামধনু উঠেছিল। সেই আলোকিত পৃথিবীর দিকে প্রথমবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম বলে কারাগারের এই অন্ধকার আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। নিশ্ছিদ্র, জমাট এই অন্ধকারের কোন রঙ হয় না। আলোর রেখা সেখানে উঁকি দিতে ভয় পায়।

[প্রহরীদের পদচারণা শোনা যায়।]

এই রাজ্যের সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার এটা এখানকার প্রহরীরা সদাসর্বদা আমাকে নিয়ে তটস্থ — স্বাভাবিক; কারণ রাজদ্রোহিতার চেয়ে বড় অপরাধ কিছু নেই। রাষ্ট্রদ্রোহিতা তবু ক্ষমা করা যেতে পারে কিন্তু রাজদ্রোহিতা হত্যা কিংবা ধর্ষণের চাইতেও ভয়ংকর আর তার শাস্তি ... তার শাস্তি — [নেপথ্য থেকে তীব্র গম্ভীর গলা ভেসে আসে —মৃত্যুদণ্ড! এই পাপিষ্ঠ নরাধমকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হল।’]

[কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। কারাগারের ঘড়িতে ঘন্টাধ্বনি বাজে।]

    তৃতীয় প্রহর শেষ হল। রাত এখন হাঁটবে ভোরের দিকে ভোর মিশে যাবে সকালের সঙ্গে। সেদিনটাও ছিল তেমনি এক আলোকিত সকাল। কাঞ্চীর রাজা মহামান্য বীরেন্দ্রপ্রতাপ কর্ণাট রাজ্য জয় করে কর্ণাটের রাজাকে কারাগারে বন্দী করেছেন। কর্ণাটের জাগ্রত দেবী বিশ্বেশ্বরীর মন্দিরে যাচ্ছেন পুজো দিতে। সঙ্গে রত্নখচিত উপঢৌকন — মহারাজের অনুগামী সেনাপতি মশাই আর আমি। কর্ণাট রাজ্য বড় সুন্দর! রাস্তার দুপাশে বড় বড় অট্টালিকাগুলো কী অপূর্ব কারুকার্যশোভিত! পত্রপুষ্পসজ্জিত উদ্যানগুলিতে সবুজের সমারোহ। মাঠভর্তি সোনার ফসল যেমন দৃষ্টিকে তৃপ্তি দেয়, গাছে গাছে পাখির কলকাকলি তেমনি মনকে ভরিয়ে তোলে। একটি মনোরম উদ্যানে কিছু বালক খেলা করছিল — বালকও নয়, শিশু বলাটাই বাঞ্ছনীয়। আর একটু এগোতেই বুঝলাম তারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে।  হাতে বাঁশের সরু কঞ্চি - তরবারির মতো আস্ফালনরত। বাঁ হাতে শালপত্র যা তাদের কাছে ঢাল। বিপুল উৎসাহে একদল অপর দলের প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা থমকে দাঁড়ালাম। মহারাজ নেতাগোছের একজন বালককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বালকগণ, কাদের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে?”

    যাকে প্রশ্ন করা হল সে সবেগে কঞ্চির এক ঘা বসিয়ে উত্তর দিল, “কাঞ্চীর সঙ্গে কর্ণাট দেশের।

    আমরা মুচকি হাসলাম। মহারাজ আবার জিজ্ঞেস করলেন, “যুদ্ধে কার জিত কার হার বালক?”

    সেই বালক অথবা শিশুটি বুকে চাপড় মেরে সদর্পে উত্তর দিল, “কর্ণাটের জিত, কাঞ্চীর হার।

    হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। কিন্তু হেসে উঠেই বুঝলাম ভুল করেছি; ক্ষমাহীন ভুল করেছি আমি। কারণ স্বয়ং মহারাজ এক বিন্দুও হাসেন নি। তাঁর চোখে মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন ফুটে ওঠে নি, বরং এক শীতল ক্রুরতা তার চোখে মুখে খেলা করছিল। সীমাহীন ক্রোধ আর অবিশ্বাস ঠিকরে বেরোচ্ছিল। সেনাপতি হল সন্ত্রস্ত আর আমি আশঙ্কিত। আমার আশঙ্কা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ মিলল অচিরেই। মহারাজ সেনাপতিকে আদেশ দিলেন পার্শ্বস্থ জনপদের উপর আক্রমণ চালাবার। একদিকে নিরস্ত্র, অসহায় গ্রামবাসী, অন্যদিকে সুশিক্ষিত, নির্দয় রাজসৈন্যের হুঙ্কার! তাদের কোষমুক্ত রক্তপিপাসু তরবারির ঝলসানিতে দেখতে না দেখতে শ্মশানের নিস্তদ্ধতা। নারী-পুরুষ-শিশু আর বৃদ্ধদের সে কী অসহ্য আর্তনাদ! সে যে কী মর্মান্তিক হাহাকার! হে ঈশ্বর রক্তস্নান করল কর্ণাটের মাটি! ধুলো জমাট বাঁধল শোণিত ধারায়! 

[আলো কমে আসে।] 

তারপর .... তারপর সব শেষ! সব চুপ .... গাছে আর পাখী ডাকল না, বাগানে আর ফুল হাসল না, হুটোপাটি করতে এল না বালক-শিশুর দল। বিশ্বেশ্বরীর মন্দির থেকে পুজো দিয়ে বেরিয়ে এলেন মহারাজ। আজ তার মুখমণ্ডলে প্রচন্ড তৃপ্তির ছাপ, স্বস্তির আলো। সেনাপতি চিৎকার করে বলল, “জয় মহারাজ বীরবিক্রম বীরেন্দ্র প্রতাপের জয়— মন্দিরের বাইরে অপেক্ষমান রাজঅনুগামী জনতা হাঁকল —জয়মহারাজ স্মিত মুখে সেনাপতিকে বললেন, ‘কেমন বুঝছ সেনাপতি?” সেনাপতি বিগলিত হয়ে বলল, “মহারাজের মান রক্ষা হল। দেবী আপনার সহায় হোন।মহারাজ গলা থেকে বহুমূল্য মুক্তোর মালা খুলে সেনাপতিকে পরিয়ে দেন। বললেন .... 

[দর্শকদের দিকে তাকিয়ে] 

কী বললেন? তোমার নির্ভীক বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছি?” না — তা বললেন না। বললেন, বললেন — তোমার রক্ত ঝরানোর ক্ষমতা দেখে, তোমার অফুরন্ত রক্তপিপাসা দেখে আমি মুগ্ধ। স্তম্ভিত, হতবাক হয়ে গেলাম আমি। এ কোন মহারাজকে দেখছি। এ তার কোন রূপ দেখছি! তাহলে এতদিন যাকে দেশশাসন করতে দেখেছিলাম, তিনি কে? এতদিন যার রাজসভায় প্রিয় বয়স্য হিসাবে হাস্যরস পরিবেশন করে এসেছি — তিনি কে? মানুষ না পিশাচ? কোনটা মুখ? কোনটাই বা মুখোশ? মুখ আর মুখোশ যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে! উপহার আর জৌলুষের সীমা পরিসীমা রইল না। মহামন্ত্রী পেলেন চন্দ্রহার, পাত্র-মিত্র -অমাত্যরা কেউ পেল হীরক, কেউ পেল স্বর্ণ। অবশেষে মহারাজ তাকালেন আমার দিকে। বললেন, “প্রিয় বিদূষক- তোমার কী চাই? রাজঅঙ্গুরীয়? না কি রত্নখচিত হার?” — ভয় লাগছিল আমার, গলা শুকিয়ে আসছিল। কী বলব? কী বলা উচিত আমার? চোখ বন্ধ করলেই কর্নাটের বালকগুলোর হাসিমুখ ভেসে উঠছে; ভেসে উঠছে তাদের রক্তস্রাবী লাশগুলো! ওরা আর কোনোদিন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবে না — আর কোন দিন বলবে নাকর্ণাটের জিত, কাঞ্চীর হার। 

কী হল বিদূষক, বললে না তোমার কী চাই? চাও, যা চাওয়ার তাই চেয়ে নাও। এই মুহূর্তে ভীষণ, ভীষণ তৃপ্ত আমি। 

আমি মহারাজের দিকে তাকালাম; বললাম, ‘যা চাই, তাই দেবেন মহারাজ?” মহারাজ মুচকি হেসে বললেন, “এ কথা কেন? তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না? বলো, কী চাও?” আমি বললাম, “বিদায়ঠিক বুঝতে পারলেন না মহারাজ। জিজ্ঞেস করলেন, “কী চাও?” আমি আবার বললাম, “বিদায় চাই মহারাজ।বিস্মিত হলেন মহারাজ, “কোথা থেকে বিদায়?”এই রাজ্য থেকে — এই দেশ থেকে — এই পরিবেশ থেকে।

মহারাজের বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। বললেন, “কিন্তু কেন? রাজ্যজুড়ে এখন সাতদিন ধরে উৎসব চলবে, আমার বিজয় উৎসব। আর এখন তুমি রাজ্য ত্যাগ করে চলে যাবে?”

"আমার যে উপায় নেই মহারাজ। উৎসবের সুর আমার কানে ঢুকবে না। আমার শ্রবণপথ এখনো কর্ণাটের আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে। উৎসবের জৌলুস আমার চোখে পড়বে না — বালক শিশুদের মৃত্যুমিছিল আমার দৃষ্টিপথকে বাষ্পরুদ্ধ করে রেখেছে। পারব না মহারাজ, পারব না আমি।

মহারাজের মুখমণ্ডল থেকে এবার বিস্ময় মুছে যাবার পালা — ফিরে আসছে ক্রোধ আর জিঘাংসার আগুন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তুমি জানো তুমি কী বলছ? তুমি কি জানো তোমার এই বক্তব্য রাজদ্রোহিতার সমতুল্য? কীসের এত অহংকার তোমার? মন্ত্রী উপহার নিতে পারল, সেনাপতি নিতে পারল আর তুমি সামান্য ভাঁড় হয়ে নিতে পারছ না?”

আমি হাত জোড় করে বললাম, “ছি, ছি মহারাজ, এমন করে বলবেন না। আমি নিতান্তই তুচ্ছ। মন্ত্রীমশাই বিদ্বান, রাজকার্যে আপনাকে উপযুক্ত পরামর্শ দেন। সেনাপতিমশাই মারতে পারেন, কাটতে পারেন, ধরতেও পারেন। কিন্তু আমি ওসব কিছুই পারি না । বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি, হাসাতে পারি। আমার ভয় হচ্ছে মহারাজ- এরপর হয়তো ওই সামান্য ক্ষমতাটুকুও আমার চলে যাবে। দোহাই মহারাজ - আমার হাসিটুকু অন্তত আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না।

[নেপথ্য থেকে উৎসবের বাজনা বেজে ওঠে।]

মহারাজ বললেন, “ওই শোনো বিদূষক — উৎসব শুরু হয়ে গেছে। [শাঁখ বাজে।] মাঙ্গলিক শঙ্খনাদ শোনা যাচ্ছে। এই শুভ মুহূর্তে আমি কোনো বয়স্যের হত্যা চাইছি না। আমি আজকের দিনটা তোমাকে সময় দিলাম ভাবো, খুব ভালো করে ভাবো। কাল আবার আমি তোমাকে পুরস্কার দিতে চাইব। যদি কালকেও প্রত্যাখ্যান করো, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই তোমার স্থান হবে কারাগারের অন্ধকূপে। যাও 

[কিছুক্ষণ নীরবতা উৎসবেব বাজনা স্তিমিত হয়ে আসে।] 

— গেলাম; কারাগারে নয় — পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করি নি আমি। সেই রাতেই কাঞ্চী রাজ্য থেকে গোপনে পালালাম।ছেলে-বৃদ্ধ-শিশু সবাই নাচছে উৎসবের আনন্দে। সেই আনন্দের ঢেউকে পিছনে ফেলে, খুশীর আলোকে পেছনে ফেলে অন্ধকারে পথ হাঁটতে লাগলাম — হাঁটতে লাগলাম সারা রাত ...  হাঁটতে হাঁটতে রাত শেষ হয়ে এল, ধ্রুবতারার উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে গেল, শুকতারা উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগল — বালিহাঁসের দল সার বেঁধে নদীর দিকে উড়তে শুরু করল আর আমিও পৌঁছলাম এক নতুন রাজ্যে। সে রাজ্যের নাম সূর্যনগর। মনে হল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার নিশ্চয়ই সূর্যের মতো আলোকিত এই নগরীতে নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিতে পারব। এখানে নিশ্চয়ই বালক আর শিশুর রক্তে হোলি খেলা হয় না। রাজপ্রাসাদের নামটিও অদ্ভুত — সূর্যগড়। মহারাজার নাম সূর্যকুমার, রানীমা সবিতা ও রাজপুত্র অংশুমান। প্রত্যেকেই সূর্যের নামে নামাঙ্কিত। রাজপ্রাসাদের অদূরেই বিরাট মন্দির — সূর্যদেবের নামে উৎসর্গীকৃত। মহাধূমধামসহকারে সূর্যদেবের পূজা হয়; নৈবেদ্য নিবেদন করেন স্বয়ং সূর্যকুমার। কাঁসরঘন্টার শব্দ আর  ধূপধুনোর গন্ধে মন্দির প্রাঙ্গণ আলোড়িত। অজস্র ভক্ত হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা-আরতি শেষ হল — অপেক্ষমান ভক্তরা হর্ষধ্বনি করে, ‘জয় ভগবান সূর্যনারায়ণের জয়,’ ‘জয় মহারাজ সূর্যকুমারের জয়।কিছুক্ষণ পরে মহারানী ও রাজপুত্রকে নিয়ে মহারাজ বেরিয়ে এলেন। প্রজাবৃন্দের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন — উঠে বসলেন রাজরথে। কিন্তু কী আশ্চর্য! মহারাজ চলে যাওয়ার পরেই ভক্ত বৃন্দের মধ্যে যেন হঠাৎ হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কোনো রকমে প্রসাদ সংগ্রহ করে  প্রত্যেকেই যেন মন্দির প্রাঙ্গন ত্যাগ করে যেতে প্রস্তুত। তবে কি মন্দিরে অবস্থিত সূর্যদেব নন? মহারাজ সূর্যকুমারের উপস্থিতিই প্রজাবৃন্দের একমাত্র আকর্ষণ? না, ভুল ভাঙল অচিরেই। মন্দিরের পুরোহিত প্রসাদ বিতরণ শেষ করে, বিগ্রহের শয়নের ব্যবস্থা করে মন্দিরের অন্যান্য কর্তব্য সমাপনান্তে যখন বাইরে এসে মূল ফটক বন্ধ করতে যাচ্ছেন, তখন আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলেন। আমি তখনো মুগ্ধ হয়ে মন্দির গাত্রে খোদিত অপূর্ব কারুকার্য দেখছি। পুরোহিত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “একি! এখনো এখানে দাঁড়িয়ে।— আমি জানালাম যে আমি মন্দিরের শোভা দেখছি। উনি সন্ধানী দৃষ্টিতে কয়েক পলক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন; তারপর বললেন-বিদেশী নিশ্চয়ই?” আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই বললেন, “তাই বলো, ঠিকই বুঝেছি আমি। বিদেশী বলেই জানো না সূর্যনগরে সূর্যাস্তের পর কোনো নাগরিকের আর বাইরে থাকার হুকুম নেই। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যেককে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতেই হবে।এবার বিস্মিত হওয়ার পালা আমার, “কেন ঠাকুরমশাই, এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন?” পুরোহিত দ্রুত হাতে তালা লাগাতে লাগাতে বললেন, “কেন আবার? এ রাজ্যের নাম সূর্যনগর তাই; এখানকার রাজার নাম সূর্যকুমার তাই। এখানকার জীবন শুরু হয় সূর্যকে ঘিরে — সূর্যালোকের প্রাখর্যই এই রাজ্যের জীবনীশক্তি। রাত্রির অন্ধকারের কোন ঠাঁই নেই এখানে।

সে কি ! পূর্ণিমার চাঁদ দেখে না কেউ?”

 নাঃগলানো রূপোর মতো জ্যোৎস্না?”  

কেউ না, কেউ না। 

কালো চাঁদোয়ার বুকে হলুদ চুমকি বসানো নক্ষত্র শোভা?”  

পুরোহিতমশাই যেন শিউরে উঠলেন, “কার ঘাড়ে কটা মাথা?” 

জিজ্ঞেস করলাম, “কেউ যদি রাত্রে বেরোয়? যদি কেউ রাজাদেশ লঙ্ঘন করে?” 

নির্বাসন, অথবা মৃত্যু। এর অন্যথা নেই।

    চমকে গেলাম আমি। কী আশ্চর্য মিল! কাঞ্চীরাজ্য আর সূর্যনগর! মহারাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ আর সূর্যকুমার! কী অদ্ভূত সাদৃশ্য! দুই রাজ্য, দুই রাজা অথচ এক — আমিত্বের কী প্রবল আস্ফালন! হা ঈশ্বর — কী অনিবার্য সমাপতন!

    কী হল, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ?” পুরোহিতের কথায় সম্বিৎ ফেরে আমার। তাই তো — কিন্তু যাব কোথায়? শুনে পুরোহিত মশাই কয়েক মুহূর্ত ভেবে বললেন, “এখানে অনেক ধর্মশালা আছে। সেখানে স্বল্পমূল্যে বিদেশী পথিকদের আহার-বাসস্থানের বন্দোবস্ত আছে। যাও, দেরি কোরো না। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসার আগেই কোনো ধর্মশালায় প্রবেশ করো। আমিও প্রস্থান করি। দেরি হয়ে গেলে রাজপেয়াদা আমাকেও ছাড় দেবে না।

    চলে গেলেন পুরোহিতমশাই। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তাকালাম আকাশের দিকে। গোল থালার মতো চতুর্দশীর চাঁদ উঠছে পূর্বদিকে। সূর্যনারায়নের মন্দির প্রাঙ্গণ ধুয়ে যাচ্ছে দুধঢালা জ্যোৎস্নায়। এই অপার্থিব সৌন্দর্য এ রাজ্যে কেউ দেখতে পায় না! আচ্ছা, সূর্যনগরের মতো যদি চন্দ্রনগর বলে কোন রাজ্য থাকত?সেখানকার মহারাজের নাম যদি হতো চন্দ্রকুমার? তাহলে কি সেখানকার প্রজারা দিনের বেলায় বেরোতে পারত না? কোনোদিন সূর্যের আলো দেখতো না? বর্ণালীর বিচ্ছুরণে মুগ্ধ হত না? 

    এইসব সাতপাঁচ ভাবছি আর ধর্মশালার দিকে দ্রুত হাঁটছি ... হঠাৎই ... হঠাৎই মেয়েলি কণ্ঠে খুব চেনা একটা গানের কলি ভেসে এল — [নেপথ্যে থেকে শোনা যায়] আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে/ বসন্তের এই মাতাল সমীরণে/ আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে - চমকে উঠলাম। কে গায়? কে গায় এই গান? জ্যোৎস্না বন্দনার এই অপরূপ গানটি কে গাইছে? সে কি অন্তঃপুরবাসিনী অথবা অভিসারিকা — সামনের রাস্তার বাঁকটা ঘুরতেই দেখলাম তাকে। অভিসারিকাই বটে — ছায়াঘন এক বটবৃক্ষের নীচে তার প্রেমিককে গান শোনাচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবলাম এরা কি তবে আমার মতোই বিদেশী? এ রাজ্যের রাজাদেশ জানে না? অথবা এদেশীয়; কিন্তু প্রণয়ের দুর্বার আকর্ষণে বেপরোয়া! অদম্য কৌতূহলেই গিয়ে দাঁড়ালাম তাদের সামনে। ভূত দেখার মতো তারা প্রথমে চমকে উঠল — বোধহয় ভাবল রাজার প্রহরী। ভুল অবশ্য তারপরেই ভাঙল। জিজ্ঞেস করলাম, “ কেন? এত বড় ঝুঁকি কেন?” যুবকটি বলল, “তাদের প্রনয়ের পথে বাধা তাদের পরিবার। দিনের বেলা দেখাসাক্ষাৎ করা সম্ভব নয় — তাই রাত্রির অন্ধকারে  সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে এই গোপন অভিসার গোবিন্দদাসের রাধিকার কথা মনে পড়ল — গাগরি বারি ঢারি করি পীছল/চলতহি অঙ্গুলি চাপি/ মাধব, তুয়া অভিসারক লাগি। যুবকটি আমার হাত চেপে বলল, “বলবেন না, দয়া করে এ কথা কাউকে বলবেন না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।আমি বললাম, “কিন্তু এভাবে কতদিন? কতদিন বাড়ির লোক আর রাজপ্রহরীদের চোখে ধুলো দেওয়া সম্ভব?” বাঁশির মতো গলায় মেয়েটি বলল, “চলে যাব আমরা — এই সূর্যনগর ছেড়ে অনেক দূর চলে যাব। জ্যোৎস্নার হাসিকে যে রাজা মূল্য দেয় না, সেই রাজার দেশ ছেড়ে চলে যাব।মনে মনে বললাম,“তোমাদের মিলন অক্ষয় হোক।মুখে বললাম, “সাবধানে থেকো।

রাতের বাসস্থান খুঁজে নিলাম এক পান্থশালায় কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। পরদিন সকালেই রাজপেয়াদা এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল রাজার কাছে। তার কাছেই শুনলাম আরও মর্মান্তিক এক সংবাদ। গত রাতে দেখা সেই ছেলেমেয়ে দুটিও প্রহরীদের হাতে ধরা পড়েছে। ছেলেটিকে দেওয়া হয়েছে আজীবন কারাবাস এবং মেয়েটির বরাদ্দ নির্বাসন। রাজসমীপে উপস্থিত হলে মহারাজ সূর্যকুমার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমাকে দেখে বললেন, “তুমি গতকাল এ রাজ্যের নিয়ম ভঙ্গ করেছ। তুমি জানতে না রাত্রে এদেশে বাইরে বেরোনো নিষেধ?” — বিনীতভাবে জানালাম, “আমি বিদেশী মহারাজ, সদ্য সূর্যনগরে পদার্পন করেছি।সূর্যকুমার এক মুহূর্ত্ত ভেবে বললেন, “উত্তম, বিদেশীদের প্রথম অপরাধ আমি ক্ষমা করে থাকি। কিন্তু স্মরণে রেখো — এই অন্যায় দ্বিতীয়বার করলে কিন্তু ক্ষমা নেই। যাও, তুমি এখন আসতে পারো।

চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। মহারাজ ভ্রু কোঁচকালেন, “আবার কী হল?”

একটা নিবেদন ছিল মহারাজ।

কী নিবেদন?”

কাল রাতে ধৃত প্রেমিকযুগলকে আপনি দণ্ড প্রদান করেছেন। আমার বিনীত অনুরোধ আপনি ওদের ক্ষমা করে দিন।

অসম্ভব! ওরা এর পূর্বেও প্রহরীদের হাতে ধরা পড়েছে। একাধিকবার সতর্কিত হয়েছে। অতএব ক্ষমার প্রশ্নই ওঠে না।

ওরা চুরি-ছিনতাই, প্রতারণা, খুন, রাহাজানি ইত্যাদি কোনো অপরাধ করে নি মহারাজ।

প্রয়োজন নেই। সূর্যকুমারের মুখমণ্ডল কঠিন হতে থাকে, “জ্যোৎস্নালোকে তারা মিলিত হয়েছিল।

কিন্তু জ্যোৎস্না আর প্রেম যে সমার্থক মহারাজ।

সেটা অন্য রাজ্যে হতে পারে। কিন্তু সূর্যনগরে জ্যোৎস্না আর রাজদণ্ড সমার্থক।

আমিত্বের এই সর্বগ্রাসী প্রচার কেন মহারাজ? এ যে অর্থহীন।

স্তব্ধ হও বিদেশী,” মহারাজ হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, “অনেকক্ষণ তোমার বাচালতা সহ্য করেছি। আর একটি বাক্যও যদি উচ্চারন করো, তাহলে তোমার মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত।

আমি দ্বিতীয়বার ভয় পেলাম। তাই আবার পালালাম। কারাগারের অন্ধকূপকে এড়াবার জন্য আমি আবার রাতের অন্ধকারে পালালাম। অন্ধকারের মধ্যে পথ হাঁটতে হাঁটতে শুধু ভাবছিলাম — আবার, আরও একবার হেরে যেতে হল।  হেরে যেতে হল রাজকীয় দম্ভের কাছে, হেরে যেতে হল রাজদণ্ডের আস্ফালনের কাছে। আসলে হেরে গেলাম এক তীব্র ভয়, আতঙ্কের কাছে। কারাগারের অন্ধকারে পচে মরার ভয় অথবা মৃত্যুদণ্ডের ভয়! সূর্যনগরের সীমানা যখন প্রায় অতিক্রম করে এসেছি, জ্যোৎস্নাঢালা চাঁদটা যখন কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়ছে না, স্রোতস্বিনী বেত্রবতীর জল যখন গলানো রূপোর মতো চকচক করছে — তখনই, তখনই ভেসে এল একটা গান — চোখের জলের লাগল জোয়ার; সম্মুখে পারাবার ... ও চাঁদ   চমকে উঠলাম! এ গলা তো চেনা! কালকের সেই মেয়েটি! যার নির্বাসন হয়েছে। আরও একটু এগোতেই দেখলাম তাকে। বেত্রবতীর তীরস্থ একটি বৃহৎ উপলখণ্ডের উপর বসে গাইছে। নদীতটের এলোমেলো হাওয়ায় তার মাথার চুল উড়ছে — আলো-আঁধারির প্রেক্ষাপটে মেয়েটি যেন এক অপার্থিব ছবি হয়ে আছে। তাকে ডাকতে পারলাম না; তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও সাহস পেলাম না। ভয়, ভয় — আদ্যন্ত শুধু ভয়টাকেই জড়িয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম — অনেক, অনেক দূর পর্যন্ত তার গানের সুর আমাকে তাড়া করে বেড়াল।

তারপর কত দিন, কত রাত কাটল। সূর্য উঠল, অস্ত গেল। অবশেষে একটি সুন্দর জনপদ আমার নজরে এল। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন রাতের অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। রাজপথে মশালের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।  দেখে আশ্বস্ত হলাম — এখানে অন্তত সন্ধ্যার পরেও লোকজন রাস্তায় নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াতে পারে। সম্ভ্রান্তবংশীয় একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,“মশাই, এই রাজ্যের নাম কী?”

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন; নমস্কার করলেন। কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে চলে এলেন। কী ব্যাপার? ভদ্রলোক কি আমার প্রশ্নটা শুনতে পান নি? হবেও বা। দ্বিতীয় আর একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। ওমা! সেও দেখি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেল। যাব্বাবা; উত্তর দেয় না কেন? বোবা না কালা! অভদ্রও তো বলা যাবে না কারণ হাত জোড় করে নমস্কার করছে — এ কী বিটকেল রসিকতা! হাঁটতে হাঁটতে একটা মনিহারি দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বলুন তো মশাই। এখানে কেউ প্রশ্নের উত্তর দেয় না কেন? সবাই কি বোবা-কালা?” দোকানদার কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইল। তারপর একটা কাগজে কিছু লিখে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। কাগজে কী লেখা ছিল জানেন? লেখা ছিল —এ রাজ্যে কেউ কথা বলে না। প্রকাশ্যে কথা বলা রাজার নিষেধ। আবার ! আবার রাজার আদেশ-নিষেধ! এই বিশাল পৃথিবীর একটা রাজ্যও কি নেই যেখানে রাজার আদেশ চলে না? একটা ক্ষুদ্র জনপদও কি নেই যেখানকার অধিবাসীদের উদয়াস্ত রাজার নিষেধের ভয়ে ত্র্যস্ত থাকতে হয় না? দোকানদারটিকে জিজ্ঞেস করলঅম, “কেন এই আদেশ, জানা আছে আপনার?”

মাথা নাড়ল লোকটা। সত্যিই তো — ওর জানার কথাও নয়। এ রাজ্যে তাহলে কেউ গান গায় না? পাঠশালায় গুরুমশাই ছাত্রদের পড়ান না? দোকানদার আবার লিখল, “রাজসভার কিছু নির্দিষ্ট গায়ক আছে যারা গান গাওয়ার সুযোগ পায়। পাঠশালায় গুরুমশাই অবশ্যই পাঠদান করতে পারেন কিন্তু রাজপ্রহরীদের উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক। জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? তাদের ছাত্রাবস্থা কি কাটেনি?”

এবারে দেখি লেখা আছে কাগজে —মহারাজের শিক্ষা দপ্তরের নির্দিষ্ট পুঁথি আছে, শিক্ষাক্রম আছে। প্রহরীরা লক্ষ্য রাখে গুরুমশাই সেই শিক্ষাবিধি লঙ্ঘন করে অন্য কিছু শিক্ষা দিচ্ছেন কি না। জাতীয় শিক্ষানীতি লঙ্ঘন করলেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার ও হাজতবাস। বেশ কিছুদিন পর এই জাতীয় শিক্ষানীতির এক টুকরো নিদর্শন লাভ করে আঁতকে উঠেছিলাম। সরস্বতী বন্দনা নয়, শিক্ষার সূচনা ঘটে রাজবন্দনার মাধ্যমে —

       রাজা পিতা রাজা মাতা
              রাজা ভগবান
       রাজা গুরু রাজা ত্রাতা
              গাও জয়গান।
       একমনে যে প্রজা
              পূজে রাজপদ,
       তুষ্ট রাজা তার প্রতি
              থাকে না বিপদ।
       ধন্য রাজা ধন্য তুমি
              দয়া-মায়ার ভরা,
       রাজ আলোকেই দেখব মোরা
              বিধাতার এই ধরা।

    সেই রাজ্য থেকে বিদায় নেওয়ার আগে রাজসভার সভাপণ্ডিতকে একবার একান্তে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “রাজবন্দনা কি আপনার রচনা?”

সভাপণ্ডিত সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই আমি বলেছিলাম, “যা লিখেছেন, তা বিশ্বাস করেন?”

সভাপণ্ডিত মৃদু হেসেছিলেন। ফিসফিস করে বলেছিলেন,“পাগল!

তাহলে এই মিথ্যা স্তব লিখলেন কেন? শুধুই পারিতোষিকের লোভে?”

চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে সভাপণ্ডিত বলেন,“ নইলে মাথাটা আর আস্ত থাকত না। 

কিন্তু কেন পণ্ডিতমশাই? কারও কথা বলার অধিকার নেই কেন?”

স্মিত হেসে ইশারায় আমাকে মৌন থাকতে বলে একটি চিরকূটে কয়েক ছত্র লিখে দেন —

                     [তবলার বোল এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হবে]

                     সত্যি কথা বললে কি আর
                           প্রাণটা দেহে থাকত?
                     জল্লাদের খাঁড়া কবেই
                           ঘাড়ের উপর নামত।
                     প্রজার মুখে থাকলে ভাষা
                           চুপ করে কি থাকবে?
                     কোন বেফাঁসে মুখে ফুটে ঠিক
                           রাজার নিন্দে সারবে।
                     মুখে কুলুপ, বোবা সবাই
                           মুখর হলেই সাজা,
                     প্রতিবাদী ভুললে ভাষা
                           তুষ্ট হবেন রাজা।

    প্রথমদিনের রাজসভার অভিজ্ঞতার কথাই বা ভুলি কী করে? মহারাজার জন্মদিন উপলক্ষে রাজসভায় আনন্দ-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশের যত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি আছেন, যারা স্বনামখ্যাত, প্রত্যেকেই রাজামশাই এর কাছ থেকে অমূল্য সব উপহার পেলেন। তবে সবাই যে পুরস্কার পেলেন, তা নয়। একজন প্রতিশ্রুতিমান কবি এবং গায়কের কপালে জুটল তিরস্কার। পরে নিভৃতে সভাপণ্ডিতকে যখন এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন বলেছিলেন,

ওরা যে পরিবর্তনপন্থী।

সেটা কি অপরাধ?”

ভীষণ। ওরা বর্তমান মহারাজার অপসারণ চায়। ওরা নিজেদের লেখা গান এবং কবিতার মাধ্যমে বিরুদ্ধ জনমত গড়ে তুলতে চায়। এই মহারাজ দীর্ঘদিন জগদ্দল পাথরের মতো এদেশ শাসন করে আসছেন।

কিন্তু ইতিহাস তো বলে সাম্রাজ্যের হাত বদল অবশ্যম্ভাবী!

ইতিহাস শুধু বদলের কথাই বলে না, বদলার কথাও বলে।

এরা কি তাদের গানে — কবিতায় সেই কথাই বলছে?”

আপনি শুনেছেন সেই কবিতা-গান?”

 আমি মাথা নাড়লাম, “না।

ওরা গাইছে — 

[গান; ভাটিয়ালি সুরে, সঙ্গতে বাঁশি]

       মাটি আমার, ফসল আমার, আমার নীলাকাশ

       গাছগাছালি, পাখপাখালি    ভোরেরই বাতাস।

       এদের সাথেই মিশে থাকে আমারই এ শ্বাস

       মাটি আমার ... নীলাকাশ।

     আমি তো অবাক! এ তো একান্তভাবেই ব্যক্তিসত্তার গান! প্রকৃতির সঙ্গে তার নাড়ির টানের কথা রয়েছে গানে। এর মধ্যে কোনো রাজবিরোধী কথা বা পরিবর্ত্তনের কথা তো নেই।

    রাজপণ্ডিত চোখ কপালে তুললেন, “নেই মানে? আপনি কি কিছুই বুঝতে পারছেন না?”

    সত্যিই আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার বিহ্বল অবস্থা দেখে রাজপণ্ডিত মুচকি হেসে ব্যাখ্যা করে দিলেন, “মাটি, ফসল, নীলাকাশ, গাছপালা, পাখি-টাখি এমন কি ভোরের বাতাসটুকু অবধি পরিবর্তনপন্থী কবি গায়কের দল নিজেদের বলে দাবী করছে। এটা অপরাধ নয়? সবই যদি ওদের হবে, তাহলে রাজামশাইয়ের জন্য আর পড়ে থাকল কী?”

    স্তম্ভিত হলাম! সত্যিই তো! এভাবে তো ভেবে দেখিনি!

    কিছুক্ষণ মৌন থেকে রাজপণ্ডিত বলেছিলেন, “আমি অনুমান করতে পারি আপনি এই মুহূর্তে কী ভাবছেন?”

পারেন?”

বোধহয় পারি। আপনি ভাবছেন রাজতন্ত্রের এই সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে কি মুক্তি নেই?”

ঠিক তাই। এমন কোনো জনপদ বা দেশ কি আছে যেখানে রাজতন্ত্র নয়, প্রজাতন্ত্র বিরাজ করে? যেখানে প্রজারা নিজেদের কথা নিজেরা বলতে পারে? আছে আপনার জানা তেমন কোনো দেশ?”

    কিছুক্ষণ ভেবে উনি বললেন, “সম্ভবত আছে। এখান থেকে বহু যোজন দূরে সমুদ্রের ধারে একটা দেশ আছে শুনেছি। আমাদের দেশের গুপ্তচরেরা খবর এনেছিল সেখানকার প্রজারা নাকি মহারাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাজপ্রাসাদ দখল করেছে। রাজা-রানী,মন্ত্রী, সেনাপতি সহ সবাইকে বন্দী করেছে।

সে কি! এ যে উলট পুরাণ! রাজশক্তি কি কখনো পরাজিত হতে পারে?”

পারে আর পারে বলেই আমাদের মহারাজা এত সতর্ক, এত আগ্রাসী। কিন্তু মহারাজ ভুলে যাচ্ছেন এভাবে অনিবার্যতাকে প্রতিরোধ করা যায় না। পতঙ্গের ডানায় মাখা ফুলের রেণু কত দূরে উড়ে গিয়ে পরাগ সঞ্চার ঘটায়।

অর্থাৎ বিদ্রোহের বার্তাও বাতাসে ভাসতে ভাসতে এ রাজ্যে পৌঁছবে বলছেন?”

পৌঁছনোই তো উচিত। মানবতার এতবড় জয় কি শুধু একটা রাজ্যেই সীমিত থাকবে?”

    আমি তখন উত্তেজনায় ফুটছি। অসম্ভবকে সম্ভব করে  তোলার সেই স্বর্গরাজ্যে আমাকে পৌঁছতেই হবে। যত দূর হোক, যত দুর্গমই হোক সেখানে আমাকে পৌঁছতেই হবে। জানা-অজানা কত লোককে জিজ্ঞেস করে, কখনো পথ ভুল করে; কখনো বা পথ খুঁজে খুঁজে পাড়ি জমালাম সেই স্বপ্নপুরীর দিকে। আমার গোটা শরীর জুড়ে কলরব উঠছে — উই শ্যাল্ ওভার কাম/ উই শ্যাল্ ওভার কাম - উই শ্যাল্ ওভারকাম সাম্ ডে .... ও হো - ডীপ্ ইন মাই হার্ট/ উই ডু বিলীভ্ ..... উই শ্যাল্ ওভারকাম সাম্ ডে ” ....... “আমরা করব জয় , আমরা করব জয়/আমরা করব জয় নিশ্চয় .... ও হো, মন্ মে হ্যায় বিশোয়াস্ / পুরা হ্যায় বিশোয়াস্ / আমরা করব জয় নিশ্চয় ...

    অবশেষে পৌঁছলাম সেই রাজ্যে। রাজ্যের প্রবেশ পথে বিশাল এক বিজয়তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে — রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের এই জয় দীর্ঘজীবি হোক। গণতান্ত্রিক এই রাজ্য সম্পূর্ণভাবে জনগনের। এই রাজ্য জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য পরিচালিত। এই রাজ্য সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে। 

[নেপথ্য থেকে লং লীভ লিবার্টি, ইক্যুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি”]

    কতক্ষণ ধরে যে সেই তোরণের দিকে তাকিয়ে ছিলাম ঠিক নেই। আমার এতদিনের সমস্ত আশঙ্কা, ক্লান্তি, শ্রান্তির বুঝি অবসান ঘটল। সেই কাঞ্চী রাজ্য থেকে সূর্যনগর, সেখান থেকে আরেক রাজ্য — আতঙ্ক আর গ্লানির কালিতে মাখামাখি সেই দিনগুলো। কখন যে আমার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, আমি নিজেই জানি না। তাজমহলের নগ্ন শুভ্রতায় যে লিপি উৎকীর্ণ আছে, আমি তাই মনে মনে আওড়াতে লাগলাম হামিন অস্ত, হামিন অস্ত, হামিন অস্তপৃথিবীর বুকে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে — তাহলে তা এখানেই, তা এখানেই, তা এখানেই।

[কিছুক্ষণ নীরবতা। ঢং ঢং করে কারাগারের ঘড়িতে  চারটে ঘন্টা বাজে। প্রহরীদের জুতোর আওয়াজ শোনা যায়। শোনা যায় হু-শি-য়া-র।]

    কী ভাবছেন? সত্যিই সেই গণতান্ত্রিক রাজ্য স্বর্গ হয়ে দেখা দিল কিনা? [একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে] স্বর্গ! ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর — আমিও তো স্বর্গ খুঁজে খুঁজেই গেলাম। সেই গণতান্ত্রিক রাজ্যে তখন একটা বড় উৎসব চলছিল। কীসের উৎসব জানেন? হত্যার উৎসব — রাজা-রানী অথবা রাজপরিবারের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল — তাদের প্রত্যেককে বন্দী করে নির্বিচারে হত্যালীলা! প্রতিদিন কুড়িজন করে রাজপরিবার বা তার স্নেহধন্য ব্যক্তিদের উন্মুক্ত ময়দানে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। সাক্ষী থাকে জনসাধারণ। জল্লাদের তরবারির আঘাতে  একেকজনের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভূলণ্ঠিত হয়ে পড়ছে আর অপেক্ষমান জনতা উল্লাসে শীৎকার করে উঠছে -জয় গণতন্ত্রের জয়তারা গুনতে থাকে ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো — ক্রমশ রাজপরিবার নিঃশেষিত হয়ে গেল। ফুরিয়ে গেল মন্ত্রী, সেনাপতি, পাত্র-মিত্র, অমাত্যদের পরিবার। কিন্তু গরিবগুর্বো মানুষের রক্ততৃষ্ণা মেটে না। রক্ত আরও রক্ত চাই — প্রতিদিন বিনা খরচে বিনোদনের এতবড় সুযোগ জনগণ ছাড়বে কেন? তাই খোঁজ পড়ল রাজ্যের অভিজাত পরিবারগুলোর। তারা কেউ অত্যাচারী ছিলেন না; তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই রাজপরিবারের ক্ষীণতম সম্পর্ক ছিল না। তবু বলিদানের সংখ্যা পূর্ণ করতে প্রতিদিন তাদের এগিয়ে আসতে হল। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতাকামী জনগণের রক্তস্পৃহা দেখে শিউরে উঠলাম। তবে কি রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই? তফাত নেই রাজা-প্রজার মধ্যেও। নাকি রাষ্ট্রক্ষমতা যার করায়ত্ত, রক্ত ঝরানোর অধিকারও একান্তভাবে তারই?

    স্তূপীকৃত কাটা মুন্ডু দেখে যারা নাচছিল, তাদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এই উন্মত্ত প্রতিশোধের কোনো প্রয়োজন ছিল?”

    চোখে মুখে রক্ত লেগে থাকা লোকটি চোয়াল শক্ত করে বলেছিল,“আপনি বিদেশী, তাই জানেন না এই রাজপরিবার এতদিন ধরে কী অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে সাধারণ মানুষের উপর। রাজার পেয়াদারা গবীর প্রজাদের বাড়ির মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। দুর্ভিক্ষের যন্ত্রণায় মানুষ যখন রাজদরবারে খাজনা মকুব করার কথা বলতে এসেছে, তখন তাদের কপালে জুটেছে চাবুকের আঘাত। মহারানী যখন শুনেছেন রাজ্যবাসীর পেটে ক্ষুধার ভাত জুটছে না, তখন তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন, “ভাত পাচ্ছে না খেতে? তাহলে পোলাও খাক।

    কী অসহ্য অপমান ভাবতে পারেন? বহুদিন ধরে রাজ্যবাসী মুখ বুজে সহ্য করেছে; তারপর যেদিন সব সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে সেদিন সিংহাসন থেকে রাজাকে টেনে নামানো হয়েছে। ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে।

     কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের জন্য যে লড়াই, তা যে আজ বদলার নেশায় পর্যবসিত হয়েছে।

    লোকটি উদ্ধতভাবে বলে, “তাতে কী? এতদিন ওরা আমাদের মেরেছে। এখন আমাদের হাতে ক্ষমতা এবার আমরা ওদের মারব। আপনি বহিরাগত — আমাদের দেশের ওরা-আমরার সমীকরণটা আপনি ঠিক বুঝবেন না।

    কিন্তু ওদের সঙ্গে আপনাদের তফাত কী রইল?”

    তফাত নেই তো, কিছু তফাত নেই। এতদিন ওরা রক্ত চুষেছে — এখন আমরা চুষব। এতদিন মহারাজের চোখ দিয়ে আমরা পৃথিবীটাকে দেখতে বাধ্য হয়েছি। এখন আমরা যেমন দেখাব — সবাইকে তেমনি দেখতে হবে। প্রতিশোধ ... প্রতিশোধ ... 

    তাই তো !অ্যান্ আই ফর অ্যান্ আই, আ টুথ্ ফর আ টুথ্। বললাম, “কিন্তু সত্য, মানবিকতা

    গুরু ঠাকুরের মতো কথা বলবেন না”, লোকটি খিঁচিয়ে উঠল, “সত্য, মানবিকতাকে আমরা চিলেকোঠার ঘরে তুলে রাখব।

    ফিসফিস করে বললাম, “এত মৃত্যু দেখতে ভালো লাগে? এত রক্ত ঘাঁটতে ভালো লাগে?”

    চকচক করে উঠল লোকটির মুখ, “ভালো লাগে; ভীষণ ভালো লাগে। রাজরক্ত ঘাঁটতে ভীষণ ভালো লাগে। ওই দেখুন অপেক্ষামান জনতা রক্তের নেশায় কেমন বুঁদ হয়ে আছে। আরও আরও শিরশ্ছেদের অপেক্ষায় চিৎকার করছে ওরা।

    কিন্তু এরপর যেদিন অভিজাত সম্প্রদায়ও নির্মূল হয়ে যাবে, সেদিন? সেদিন বলি জুটবে কোত্থেকে? এদের অফুরন্ত রক্ত তৃষ্ণাই বা মিটবে কীসে?

    সেদিন শুরু হবে মুষল পর্ব। সেদিন আর আত্মপর থাকবে না। রক্ত ঝরানোই হবে মূল লক্ষ্য।

    কাহিনি প্রায় সমাপ্তির মুখে। পরদিন খুব সকালে সেই গণতান্ত্রিক দেশ ত্যাগ করলাম। নগরের উপান্তে যখন এসে দাঁড়ালাম, ভোরের প্রথম অরুণ ছটা তখন পড়ছে সেই বিশাল তোরণদ্বারে। আবার চোখে পড়ল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা। কী নির্লজ্জ রসিকতা! কী নির্মম সত্য! একটা ভারি নিঃশ্বাস পড়ল।

    কী দেখব বলে এসেছিলাম আর ... মনে হল আমার মতো স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাতেই বোধ হয় সেই কবি বলেছিলেন —

    “ I heard a thousand blended notes
       while in a grove I sat reclined,
       In that sweet mood when pleasant thoughts
       Bring sad thoughts to the mind.
       To her fair works did Nature link
       The human soul that through me ran;
       And much it grieved my heart to think
       What man has made of man.
       Through Primrose tufts, in that sweet bower
       The periwinkle trail’d its wreaths;
       And it’s my faith that every flower
       Enjoys the air it breathes.
       If this belief from Heaven he sent
       If such be Nature’s holy plan
       Have I not reason to lament
       What man has made of man?”

    রাজতন্ত্র না গণতন্ত্র — কে বেশী হিংস্র? কে বেশী নিষ্ঠুর? এই প্রশ্ন বুকে নিয়েই আমি আবার পথে নামলাম।

     কী বললেন? পালালাম কি না? নাঃ; আর পালানো নয়। যে পালায় তার কোন গন্তব্য থাকে না। নিজেকে বাঁচাতে সে উর্দ্ধশ্বাসে উদ্দেশ্যহীনভাবে পালায়। কিন্তু এই প্রথম আমি জানতাম যে আমাকে ঠিক কোথায় যেতে হবে। কাঞ্চী রাজ্য থেকে পালানোর যে ভবিতব্য আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল — আমি জানতাম এবার তার বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে। আমি তখন জেনে গেছি আমাকে ফিরতে হবে আমার অনিবার্য গন্তব্যের দিকে, আমার অমোঘ ভবিতব্যের কেন্দ্রে — ফিরতে হবে, আমাকে ফিরতেই হবে।

     ফিরলামও। ফিরলাম আবার আমার সেই আজন্ম পরিচিত কাঞ্চী রাজ্যে। সেই উচ্ছ্বলা স্রোতস্বিনী, কাশফুলের উচ্ছ্বাসে ঢাকা সেই নদীচর, শ্যামল চাদর বিছানো সেই শস্যক্ষেত্র — সব, সব একই রকম আছে। আর এত সব চেনা ছবির মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেতে ফিরে এলাম।

     ফিরে এলাম। এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক রাজার রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পালাতে পালাতে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলাম পালাবার কোন জায়গা নেই। আসলে পালাবার কোন চূড়ান্ত জায়গা থাকে না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একদিন মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়। 

    তাই তো দাঁড়ালাম। রাজবাড়ির পরিচিত দেউড়ি পেরিয়ে রাজসভায় ঢুকে সটান গিয়ে দাঁড়ালাম কাঞ্চীর মহারাজা বীরেন্দ্রপ্রতাপের সামনে। চিনতে বোধহয় মহারাজের কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর বললেন, “বিদূষক! তুমি! তুমি!

হ্যাঁ মহারাজ, আমিই।

ফিরে তাহলে আসতেই হল বিদূষক! অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে অবশেষে বুঝতে পারলে যে মহারাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপই শ্রেষ্ঠ। তাই না? ভালো, ভালো। তোমার পুরস্কার অবশ্য এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে। আশা করি এখন গ্রহণ করতে তোমার কোনো আপত্তি নেই?”

আমি জানালাম, “আমি তো পুরষ্কার গ্রহণ করতে আসি নি মহারাজ।

বটে!মহারাজের ভ্রু কুঞ্চিত হল। চোখ সরু করে বললেন, “তবে প্রত্যাবর্তনের কারণ?”

আমি— আমি সত্যি কথাটা বলবার জন্য ফিরে এসেছি।

বুঝলাম না বিদূষক — হেঁয়ালি রাখো।

কোনো হেঁয়ালি তো নেই মহারাজ। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পালিয়ে বেড়িয়েছি আমি — শুধু নিজেকে বাঁচাবার জন্য। নিছক মৃত্যুভয়ের জন্য কোনদিন কোনো  রাজার মুখের উপর বলতে পারিনি- মহারাজ, আপনি অন্যায় করেছেন, আপনি মানবতার শত্রু। না — কোনদিন বলতে পারিনি। তাই গ্লানি, শুধু গ্লানির আগুনে ক্রমাগত দগ্ধ হয়েছি আমি। ক্লেদ জমেছে অনুভূতির প্রাচীরে।

 এতদিন পর তাহলে সেই কথা বলতেই ফিরে এসেছ?”

ঠিক তাই। অন্তত একবার বাস্তব সত্যকে নিজের লজ্জিত পৃষ্ঠদেশ নয়, প্রসারিত বক্ষদেশ দিয়ে আলিঙ্গন করতে এসেছি।

তুমি জানো বিদূষক তুমি কী বলছ? তোমার এই অতি সত্যভাষণ তোমার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে?”

মৃত্যু না মহারাজ, জীবন — এক অন্য জীবন আহ্বান করতে পারে। কতবার, কতবার তো মৃত্যু হয়েছে আমার। কর্ণাটের অসহায় নিষ্পাপ বালকগুলোর আর্তনাদ যতবার আমার কানে পৌঁছেছে, ততবার আমার মৃত্যু হয়েছে। আমার এই অজস্রবার মৃতআমিটা একবার অন্তত বাঁচতে চায় — এই রাজসভায় প্রকাশ্যে ঘোষনা করছি আমি —মহারাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপ, আপনি অন্যায় করেছেন। কর্নাটের যুদ্ধে রক্তগঙ্গা বইয়ে আপনি জল্লাদ হয়ে গেছেন — মৃত শিশু আর বালকদের কাতর আর্তনাদ আপনার শ্রবন পথে প্রবেশ করে না। ধিক্কার আপনাকে, ধিক্কার…”

বিদূষক!গর্জে ওঠেন মহারাজ।

মৃত্যুদণ্ড, এবার মৃত্যুদণ্ড দিন মহারাজ। মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আমাকে বাঁচার আনন্দ পেতে দিন। বাঁচতে চাই, আমি নির্ভীক ভাবে বাঁচতে চাই।  

[শেষ কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।     

কিছুক্ষণ নীরবতা]

     মহারাজ আমাকে মারতে অথবা বাঁচাতে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। আমি ফিসফিস করে নিজেকে বললাম, পেরেছি। অবশেষে আমি পেরেছি। কারাগারের অন্ধকারে প্রবেশ করার আগে কাঞ্চীর আকাশে ফুটে ওঠা রামধনুর দিকে তাকালাম। নভোলোকের অনিঃশেষ আলো কারার অন্ধকূপকে ভাসিয়ে দিতে লাগল।

    আজই সেই দিন। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ভোরের প্রথম আলো ফুটলেই আমাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হবে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, মহারাজ আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর থেকে আমার কানে আর কর্ণাটের শিশু কিংবা বালকদের আর্তনাদ প্রবেশ করছে না। শান্তি, এক অনন্ত শান্তি আমাকে আবৃত করে রেখেছে। তৃপ্তির শেষ নির্যাসটুকু আমাকে অপার্থিব প্রশান্তি এনে দিয়েছে।

[পাখির অস্ফুট কিচিরমিচির শোনা যায়।]

    ওই বোধহয় পাখিরা জেগে উঠল; ভোরের আলো ফুটবে এবার — 

[অনেক লোকের ভারী জুতোর সম্মিলিত পদচারণার শব্দ শোনা যায়। শব্দটা ক্রমশঃ এগিয়ে আসে।] 

ওই, ওই প্রহরীরা আসছে। হয়ে এল সময়, ভূমার সঙ্গে মিশে লীন হয়ে যাবার সময় হয়ে এল। প্রস্তুত, আমি প্রস্তুত —

[জুতোর আওয়াজ ক্রমশঃ এগিয়ে আসতে থাকে। লালচে আলো মঞ্চে। বিদূষক উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে]

       নিঃসংকোচে           মস্তক তুলিতে দাও উন্নত আকাশে

                                  উদাত্ত আলোকে —

                                         মুক্তির বাতাসে।’🚫

 

সুব্রত নাগ
সুব্রত নাগ। জন্ম ১৯৬৯। ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর, পেশা শিক্ষকতা। মূলত ছোটো গল্পকার। ছাত্রাবস্থায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ, আনন্দবাজার, বর্তমান, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী সহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত। গত বছর 'কিশোর ভারতী' আয়োজিত হাসির গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন। গল্পের পাশাপাশি নাটক রচনাতেও আগ্রহী। ২০১৩ সালে 'ন হন্যতে' নাটকের জন্য পান 'সুন্দরম' পুরস্কার।

 


অ থ বা

নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার) 
ক্লিক করে সেই লেখা পড়তে পারেন  

 
 
 








 
 
 
 
 
 

 
আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏