রাঢ়বঙ্গের দুর্গাপূজা
রামামৃত সিংহ মহাপাত্র
পুরাণ অনুযায়ী প্রথম দুর্গা পূজা করেন
সত্যযুগে রাজা সুরথ। তিনি দেবী বন্দনা করেন বসন্ত কালে। পরবর্তী কালে রাজা রাম
দেবীর অকাল বোধন করেন শরৎকালে রাবণ বধের জন্য।
ইতিহাস থেকে জানা যায় রাজশাহী জেলার
তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। প্রথম
চাঁদা তুলে সর্বজনীন বা বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন করেন হুগলির গুপ্তিপাড়ার
বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু ইংরেজির ১৭৯০ সালে।
মহিষমর্দিনী দুর্গা, দেউলঘাটা, বড়াম, পুরুলিয়া। ক্লোরাইট পাথরের। আনুমানিক খ্রি. নবম শতক। |
তবে দুর্গা রূপে দেবীশক্তি বন্দনার বহুপূর্বে নারী শক্তিকে দেবী মর্যাদায় বন্দনা করা হোত রাঢ় বাংলায়। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, “আদিম কৌম সমাজের মাতৃকাতন্ত্রের দেবীদের প্রাধান্য কৌম সমাজে তো ছিলই; বিচিত্র নামে তাঁহারা নানাস্থানে পূজাও লাভ করিতেন। পরে যখন আর্য ব্রাহ্মণ্য পুরুষ-প্রকৃতি ধ্যান সুপ্রতিষ্ঠিত হইল তখন সেই মাতৃকাতন্ত্রের দেবীরা প্রকৃতি বা শক্তিরূপি বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে, বিশেষভাবে দুর্গা ও তারার সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গেলেন। যাহাই হউক, আদিপর্বের শেষ পর্যায়ে দেখিতেছি দুর্গা,তারা,ষষ্ঠী, হারীতী, মনসা, মারীচী, চুণ্ডা, পর্ণশবরী প্রভৃতি, বিশেষভাবে দুর্গা ও তারা ক্রমশ সমাদৃতা ও সুপ্রতিষ্ঠিতা হইতেছেন এবং তারার ধ্যানে তাঁহাকে একইসঙ্গে বেদমাতা অর্থাৎ সরস্বতী, গিরিজা অর্থাৎ উমা বা দুর্গা,পদ্মাবতী এবং বিশ্বমাতা বলিয়া আহ্বান করা হইয়াছে। এই ক্রমবর্ধমান মাতৃকাতন্ত্রের প্রাধান্য আদিম মাতৃতান্ত্রিক কৌম সমাজাদর্শের এবং কৌম মানসের পুনর্ঘোষণা, সন্দেহ কি!”
রাঢ় বাংলায় সেই সময়ের মূল অধিবাসী ছিল অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় শ্রেণীর
মানুষেরা। বন্দিত দেব দেবীর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় আর্য সমাজের মধ্যে দেব
বন্দনার রীতিই ছিলা প্রধান। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এই তিনজন প্রধান দেবের
প্রাধান্য ছিল বেশী। অন্যদিকে অনার্য সভ্যতায় রীতি ছিল মাতৃ বন্দনার। এরা ছিল মূলত
প্রকৃতির পূজারী। প্রকৃতি পূজার অনুষঙ্গ হিসাবে পূজিত হতেন সিনি দেবী। এই দেবী পূজার
মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের মঙ্গল কামনা, নিজের ও পরিবারের
শরীর সুস্থ রাখা,চাষাবাদ ও গৃহপালিত জীব জন্তুর শ্রীবৃদ্ধি।
গবেষক মানিকলাল সিংহ সিনিকে ফার্টিলিটি বা উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দেবী দুর্গার অন্নপূর্ণা বা শাকম্ভরী নামের মধ্যে যার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। ড. সুধীর কুমার করণের মতে সিনি শব্দটি এসেছে অস্ট্রিক শব্দ ‘সুনিয়া’ বা ‘সুনি’ থেকে যার অর্থ আরম্ভ বা আদি। এই আদি বলতে জননী বোঝায়। অর্থাৎ দুর্গার জগৎ
জননী মায়ের রূপ
লুকিয়ে আছে এই সিনি দেবী পূজার মধ্যেই। শাস্ত্রে সিনির আভিধানিক অর্থ বালা,
চন্দ্রবালা, দুর্গা। বলা যেতে পারে কুমারী
পূজার গভীর ভাবনা লুকিয়ে আছে অনার্য সংস্কৃতির এই সিনি পুজোর মধ্যে। বালা কথাটি
গ্রাম বাংলায় সাধারণ
ভাবে ব্যবহৃত হয় অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে। ঐতেরীয় ব্রাহ্মণে এবং ঋকবেদে সিনি
দেবী হিসাবে উল্লিখিত হয়েছে। মহাভারতে সিনি অংগীরার পত্নী ও শ্রদ্ধার কন্যা।
বিশ্বাস এক এক সিনি এক একটা শক্তির
প্রতীক। কেউ চাষের দেবী, কেউ সন্তান ধাত্রী আবার বা কেউ
বরাভয় প্রদানকারী দেবী। নতুন প্রস্তর যুগ থেকে চলে আসা এই শক্তি সাধনার
নবতম রূপ যে দুর্গা বন্দনা এতে সংশয়ের
কোন কারণ থাকা উচিত নয়। আবার প্রস্তর খন্ড থেকে পোড়া মাটির হাতি ঘোড়ার স্তর বেয়ে
মূর্তি পুজোর স্তরে পৌঁছনোর ঘটনাও কম চমকপ্রদ নয়।
প্রকৃতি
পূজার অনুষঙ্গ হিসাবে বলা হয়েছে, “ওঁ, অয়মূর্জাবতো বৃক্ষ উজ্জীব ফলিনী ভব।/পর্ণং বনস্পতের্নুত্বা নুত্বা চ
সূয়তাং রয়িঃ।” অর্থাৎ হে শক্তিমতী বৃক্ষ, (তুমি) বাঁচিয়া ওঠো এবং ফলবতী হও। বনস্পতির পাতাকে সেবা করিয়া ধন প্রসব
করো। বলা অত্যুক্তি হবে না এই দুর্গাপূজার আদি উৎস লুকিয়ে রয়েছে বৃক্ষ পুজোর
মধ্যে। রাঢ় বঙ্গের অন্যতম আদিম অধিবাসী সাঁওতালদের মূল দেবতা শালবৃক্ষ। এখানেও
বৃক্ষ পূজার কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতিকে বাঁচানোই ছিল এই পূজার মূল উদ্দেশ্য। এই
উদ্দেশ্য যে দুর্গাপূজার ক্ষেত্রেও গ্রহন করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবার
দুর্গাপূজা যে আদিতে শস্যদেবীর পূজা ছিল তা শাকম্ভরী নাম থেকেই প্রতীয়মান হয়।
দুর্গা পূজা প্রকৃতপক্ষে নব পত্রিকার পূজা। এই নব পত্রিকা নটি বিশেষ
প্রকার উদ্ভিদ ও লতার সমাহার। যাও প্রকৃতপক্ষে অন্ত্যজ শ্রেণীর প্রকৃতি পূজাকেই
সমর্থন করে।
দেবী দুর্গার অপর নাম অম্বিকা। আবার দ্বাবিংশতম জৈন
তীর্থঙ্কর নেমিনাথের শাসন যক্ষিণী দেবী অম্বিকা। ঐতিহাসিকদের মতে দক্ষিণ-পশ্চিম
রাঢ়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল একদা জৈন ধর্ম প্রচার ও প্রসারের উর্বর ক্ষেত্র ছিল।
অম্বিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে জৈন প্রতিষ্ঠা সারসংগ্রহ গ্রন্থে বলা হয়েছে “দ্বি-ভূজা সিংহারূঢ়া আম্রাদেবী হরিৎ প্রিয়া।” দেহ
ভঙ্গিমায় প্রকাশিত হয় স্নেহময়ী জননী রূপ। আবার যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতা তে (৩/৫৭)
অম্বিকাকে রূদ্রের ভগিনী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তৈত্তিরীয়
আরণ্যকের দশমখন্ডে অম্বিকাকে বলা হয়েছে রূদ্রপত্নী। এই অম্বিকাই আশ্বিণে পূজিত হন
দুর্গা রূপে। ষোড়শ শতকে রচিত মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আছে “আশ্বিণে অম্বিকা পূজা প্রতি ঘরে ঘরে।” সপ্তদশ শতকে
রচিত রূপরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যে আছে “কৃষ্ণ কথা রাখিয়া
নারদ মুনি/আশ্বিনে অম্বিকা পূজা করেন আপনি।” তবে জৈন
যক্ষিণী অম্বিকার যে মূর্তি গুলো এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে গঠনশৈলী দেখে অনুমিত হয়
সেগুলো সবই প্রায় দশম থেকে দ্বাদশ শতকে নির্মিত। অর্থাৎ হিন্দু দেবী দুর্গা পূজিত
হবার আগেই জৈনরা দেবী অম্বিকার আরাধনা করতো। আবার হিন্দু হর-গৌরী মূর্তির সঙ্গে
মিল রয়েছে জৈন গোমেদ-অম্বিকা মূর্তির।
প্রকৃতপক্ষে একথা অনস্বীকার্য সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই
মাতৃতান্ত্রিক সমাজে গোষ্ঠীরক্ষা থেকে শিশুজন্মদান, লালন
পালন প্রভৃতি কাজ করতেন নারীরাই। এই ভাবনা থেকেই নারীবন্দনার রীতি প্রাধান্য পায়।
দক্ষিণ-পশ্চিম রাঢ়ের শক্তি সাধনার ধারনা বদলাতে থাকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের সময় থেকে। এই সময়ে পরিবর্তিত হতে থাকে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পটভূমি। প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ভূম রাজ্যগুলি।যার অন্যতম সামন্তভূম, ধলভূম, ধবলভূম, বরাভূম প্রমুখ। এই ভূম রাজ্যগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের বেশির ভগেরই আগমন ঘটেছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের অনেক ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে মধ্যে কুলদেবী হিসাবে শক্তি পূজার প্রচলন ছিল। সেইসূত্রে উঠে আসে এক এক দেবীর নাম। ধলভূম ও ধবলভূমের দেবী রঙ্কিণী। ধবলভূম তথা খাতড়ার সুপুর পরগণা থেকে ছ'আনা অংশ নিয়ে রাজা খড়্গেশ্বর ধবলদেব স্থাপন করেন অম্বিকানগর রাজ্য। তাঁদের কুলদেবী হন অম্বিকা। প্রসঙ্গত যেসব গ্রামে অম্বিকা পূজিত হন সেই গ্রামে দুর্গা পূজা হয় না।
শিখরভূম, তুঙ্গভূম তথা গড়রাইপুর বা বর্তমান রাইপুরে রাজত্ব স্থাপন করেন চৌহান বংশীয় এক রাজপুত। তাদের আরাধ্য শক্তিদেবী ছিলেন “কোকামুখা” দেবী মহামায়া। যিনি আদিতে চন্ডী হিসাবে পূজিত হতেন। পুরান মতে চন্ডী ও দুর্গা অভিন্ন। এই দেবী পুজোর মধ্যে অস্ট্রিক সংস্কৃতির ছাপ লক্ষ্য করা যায়। সন্ধিপূজোর বলিদানের মাংস সমাধিস্থ করা হয়। এটি অস্ট্রিক সংস্কৃতির অঙ্গ। এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে প্রধান ছিল অস্ট্রিক সম্প্রদায়ের মানুষ। পরবর্তীতে আগমন ঘটেছিল দ্রাবিড় সভ্যতার মানুষদের। বরাভূমের শক্তিদেবী ছিলেন তান্ত্রিক দেবী কোঠেশ্বরী। এই দেবীর স্থানে মহিষ বলি দেওয়া হতো, যা অনার্য সংস্কৃতির বাহক। অনুরূপ ভাবে মহিষ বলি দেওয়া হতো মানভূম ও ধবলভূমে এবং বরাবাজার রাজবাড়ির মহিষমর্দিনীর পুজোয়।
দেবী কোঠেশ্বরী |
সামন্তভূমের আরাধ্য দেবী বাসুলী।তবে বাসুলী
দেবীর আরাধনার পূর্বেই বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের হাতে পূজিত হতেন দেবী মৃন্ময়ী। দেবী
মৃন্ময়ী প্রকৃতপক্ষে চন্ডিকা। মল্লরাজাদের জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এই দেবী
পুজোর প্রচলন করেন।
শবর সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে নানা ধরনের গাছ
একত্রে পুজোর রীতি রয়েছে। যা থেকে দুর্গা পুজোয় নব পত্রিকার উৎপত্তি বলে কোন কোন
গবেষক মত প্রকাশ করেছেন।
উপরে আলোচিত প্রত্যেকটি দেবী পুজোই শক্তি পুজোর
নামান্তর। যেগুলোর প্রচলন ঘটেছিল দুর্গা পূজা প্রচলনের বহুপূর্বে। কিন্তু দুর্গা
পূজার কোনো না কোনো আচার গ্রহন করা হয়েছে অন্ত্যজ, জৈন ও বৌদ্ধদের দ্বারা পূজিত
এই দেবদেবী পূজায় পালনীয় আচার আচরণ থেকে।
রাঢ়বঙ্গের
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কৌম, প্রাগার্য বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম প্রভাব বিস্তার
করেছিল। আবার কোন ধর্মধারাই অবিছিন্নভাবে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে নি। বরং
বলা যেতে পারে ধর্মীয় সংশ্লেষ ঘটেছিল। যার ফলশ্রুতিতে অম্বিকা, চণ্ডী, পার্বতী সময়ের পরিপ্রেক্ষাতে একাসনে বসেছেন।
ফলত রাঢ়বঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে শাস্ত্রীয় ধারা, শাস্ত্র
বহির্ভূত লৌকিক ধারা; সেইসঙ্গে আদিবাসী ধারা ও বিভিন্ন গৌণ
ধারা।
দেবী দুর্গার বিবর্তন হিসাবে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বক্তব্য গ্রহন করা যেতে পারে। তিনি ‘দুর্গার প্রতিমা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
“মহিষমর্দিনী প্রতিমায় উগ্রচণ্ডী শূল দ্বারা এক মহিষ বিদ্ধ
করিতেছেন। ইহাই মূল রূপ। দশভূজা দুর্গার ধ্যানে অসুরের উর্দ্ধাঙ্গ দ্বিভুজ,
খড়্গ-খেটকধারী। নিম্নাঙ্গ চতুষ্পদ মহিষ। বঙ্গদেশে এইরূপ প্রতিমা
নির্মিত হইত।শত বৎসর পূর্বেও ছিল।
“বর্তমানে দুর্গাপ্রতিমার
সহিত লক্ষ্মী সরস্বতী কার্ত্তিক গণেশের প্রতিমাও সন্নিবিষ্ট হইতেছে।কিন্ত লক্ষী
সরস্বতী দুর্গারই শক্তি। সুতরাং তাহাদের প্রতিমা প্রদর্শনের হেতু নাই। কার্ত্তিক
গণেশ প্রতিমাও অকারণ আসিয়াছে।এই চারি প্রতিমা-সন্নিবেশ দ্বারা দুর্গার মহিমা খর্ব
হইয়াছে। দুর্গা কুমারী।তাঁহার পুত্রকন্যা নাই।এই কারণে দুর্গাপূজায় কুমারী-পূজা
বিহিত হইয়াছে।”
বলা অত্যুক্তি হবে না দেবী দুর্গার এবং
দুর্গা পূজার বিবর্তন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অন্ত্যজ
থেকে উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি। এখানেই এই পুজোর সার্থকতা। তাই পরিণত হয়েছে সর্বজনীন
পরব তথা উৎসবে।
এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে রাঢ়বঙ্গের সর্বত্রই।
বাঁকুড়া জেলার হীড়বাঁধ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম দোমোহানি। এখানে দেবী পূজিত হন সম্পূর্ণ পৃথক ভাবে। পুজো করেন আদিবাসী রমনী সরস্বতী হাঁসদা “মারাং বুরু যাহা ইয়ুব মায়েন মন্ত্রে”। বৈদিক রীতি ব্যতিরেকে ২০ বছর ধরে চলে আসা এই পুজো জেলা তথা রাজ্যের কাছে অভিনবত্বের দাবি রাখে। কথিত স্বপ্নাদেশ পাবার পর সরস্বতী হাঁসদা এই পুজো শুরু করেন।
হীড়বাঁধ ছাড়াও আদিবাসী
রমণীদের দ্বারা দেবী দুর্গা পূজিত হন রাইপুর, সারেঙ্গা ও
সিমলাপাল ব্লকের বেশ কয়েকটি গ্রামে।
তবে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া
জেলার খেরওয়াল সাঁওতাল এবং অসুর আদিবাসী গোষ্ঠীর অনেকেই দুর্গা পূজার চারদিন শোক
পালন করেন হুদুর দুর্গার মৃত্যুতে। অভিমত হুদুর দুর্গা ছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষ। অসীম
ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। আর্যদের রাজা ইন্দ্র সাতবার আক্রমণ করেও হুদুর দুর্গা
কে পরাস্ত করতে না পেরে ছলনার আশ্রয় নেন। এক রমণীকে পাঠান হুদুর দুর্গা কে হত্যা
করার জন্য। আদিবাসী সমাজে রমণীদের স্থান ছিল অত্যন্ত সম্মানের। ফলে রমণী তাকে আঘাত
করলেও তিনি আঘাত করেন না। ফলত মৃত্যু হয় হুদুর দুর্গার। তাঁর মৃত্যুর পর আর্য
জাতির লোকেরা রাজ্য দখল করতে আসে। সেই সময় আদিবাসী পুরুষেরা নারীবেশে পলায়ণ করে। এই
ঘটনার স্মরণে আজও পালিত হয় দাঁসাই নৃত্য ।
যদিও গবেষকদের মতে দাঁসাই নৃত্য হলো সম্পূর্ণ রূপে কৃষিভিত্তিক পরব ও
প্রকৃতি বন্দনার উৎসব। দাঁসাই নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা
হয়।
পুরুলিয়া জেলার জয়পুর রাজবাড়িতে পূজিত হয় সোনার দুর্গা প্রতিমা। পুজো
চারদিন এই সোনার দুর্গা প্রতিমা মণ্ডপে স্থান পেলেও বছরের অন্য সময় থাকে
ব্যাঙ্কের ভল্টে। এই পুজো প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো। চালচিত্র
রূপোর। কলা বৌ হিসাবে পুজো হয় বংশানুক্রমিক প্রাপ্ত একটি খাঁড়া।
কাশিপুর গড়পঞ্চকোট রাজপরিবারের পুজো অনুষ্ঠিত হয়
১৫ দিন ধরে। জিতাষ্টমীর দিন থেকে এই পূজা শুরু হয়। দেবী রাজরাজেশ্বরী শ্যামারূপে
অবস্থান করেন। সপ্তমীর রাতে দেবীকে রাজবেশ ধারণ করানো হয়। অষ্টমীর নির্ঘন্ট
নির্ধারণের জন্য রয়েছে রাজবাড়ির নিজস্ব প্রথা। একটি পাত্রে জল রাখা থাকে। তার
ভিতরে একটি ছোট ছিদ্র যুক্ত পাত্র থাকে(জলঘড়ি)। ওই ছিদ্র
দিয়ে পাত্র প্রথমবার জলপূর্ণ হলে তাকে একপাট বলে। এইভাবে নির্ধারণ করা হয়
অষ্টমীর নির্ঘন্ট। বিশ্বাস সন্ধিপুজোর সময় সোনার থালায় রাখা সিঁদুরের উপর মা
নিজে অধিষ্ঠান হয়ে পায়ের ছাপ দিয়ে যান। পাঁচখানা বিল্বপত্রে দেবীর পা ঢাকা
থাকে। মনে করা হয় “মল্লে রা, শিখরে
পা, সাক্ষাৎ দেখবি যদি শান্তিপুরে যা” — এই প্রবাদটির প্রচলন এ কারণেই।
ভেলাইডিহা রাজপরিবারের দেবী দুর্গা |
মানবাজার
রাজবাড়ির রাজপরিবারের দুর্গামেলাটি আয়তকার। এই মন্দিরে ১৭ দিন ধরে দুর্গা পূজা
হয়।নব পত্রিকার পূজা হয়। প্রতিমা পুজো হয় না।
মল্লভূম
বিষ্ণুপুরে অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে উর্ধ্বাকাশ থেকে আকাশবাণীর মতো বহু মানুষের
সম্মিলিত ‘মা মা’ কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মা মৃন্ময়ী এখানে পূজিত হন মল্লরাজাদের কুলদেবী
হিসাবে। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পূজিত হয়ে আসছেন এই দেবী। সম্ভবত
বাংলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পুজো এটি। মৃন্ময়ী প্রকৃতপক্ষে দেবী দুর্গার ব্রাহ্মী
ও বৈষ্ণবী মূর্তি। পণ্ডিতদের মতে দেবীর এই রূপ পৃথিবীতে নয়, পুজো
হয় মর্ত্যে। দেবীর ইচ্ছানুযায়ী মুখারবিন্দটি মৃৎপ্রতিমার মুখের আড়ালে রেখে
গঙ্গামাটি দিয়ে নির্মিত হয়।
এই
দেবীর পুজোয় তন্ত্র, বৌদ্ধ সংস্কার, ভাগবতের
প্রভাব, কাত্যায়নী পুজো ইত্যাদির ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে
গেছে। এখানের পুজোর সময় তিন দিন ধরে একান্নটি শালপাতায় একান্নটি দেবীপীঠের
উদ্দেশ্যে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। পদ্মফুলের সঙ্গে দেওয়া হয় স্বর্ণচাপা ফুল।
বিষ্ণুপুরের
রাজপরিবারে দুর্গাপূজাতে মৃন্ময়ীর সঙ্গে পূজিত হন বড় ঠাকুরাণী, মেজো
ঠাকুরাণী বা মাইতো ঠাকুরাণী এবং ছোট ঠাকুরাণী বা পটেশ্বরী। জিতাষ্টমীর পর দিন বোধন
হয় বড় ঠাকুরাণীর। চতুর্থী তিথিতে আগমন ঘটে মেজো বা মাইতো ঠাকুরাণীর এবং
মহাসপ্তমীর দিন আসেন পটেশ্বরী। বৈষ্ণব মতে পূজিত দেবীর পূজায় রক্তপাত নিষিদ্ধ।
সন্ধিপুজোর সময় মাষকলাই বলি দেওয়া হয়। সন্ধিলগ্ন সূচিত হয় জলঘড়ির সময়
অনুযায়ী। সন্ধিপূজার সময় জানানোর জন্য প্রাচীন রীতি অনুযায়ী কামান দাগা হয়। দ্বাদশীর
দিন বিষ্ণুপুর নিমতলা মহল্লার রঘুনাথ জীউ এর মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে মধ্যরাত্রে রাবণ
কাটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পূজার রেশে ছেদ পড়ে।
বীরভূম
জেলার দুবরাজপুর-এ দশমীর দিন সকল পূজা মণ্ডপ থেকে জয়তারা বলে যে শোভাযাত্রা
বেরোয় তাতে তরোয়াল টাঙ্গী সহ বিভিন্ন অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়।
বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের
প্রত্যন্ত গ্রাম উত্তর রামনগরে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় সপ্তমীতে সাত, অষ্টমীতে
আট ও নবমীতে নরকম ভাজা সহ ভোগ নিবেদন করা হয়। এছাড়াও প্রথা অনুযায়ী যে কাহারেরা
দেবী প্রতিমা বিসর্জনের জন্য নিয়ে যায় তাদের এক কুই: চালের ভাত রেঁধে খাওয়ানো
হয়।
প্রকৃতপক্ষে
রাঢ় অঞ্চল বলতে যে বৃহৎ অঞ্চল কে বোঝায় তার সামগ্রিক চালচিত্র তুলে ধরা বেশ জটিল।
এখানে এই প্রবন্ধের মাধ্যমে বলা যেতে পারে সেই চালচিত্রের সূচনা ঘটানো হলো। অদূর
ভবিষ্যতে গবেষণার দ্বারা রাঢ়বঙ্গের পুজো নিয়ে আরও বিশদ তথ্য উঠে আসবে বলে আমার
বিশ্বাস। 🚫
রামামৃত সিংহ মহাপাত্র |
জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম
লক্ষ্যাপাল-এ। পিতার চাকুরি সূত্রে বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনা বীরভূম জেলায়।
শিক্ষাগত যোগ্যতা এম এস সি বি এড। পেশা শিক্ষকতা।
লেখালিখি — মূলত গল্প। পাশাপাশি জৈন
পুরাতত্ব এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতি তথা লোকসংস্কৃতির
উপর গবেষণা মূলক প্রবন্ধের লেখক।
প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় বীরভূম জেলার দুবরাজপুর থেকে প্রকাশিত চণ্ডীদাস
পত্রিকায়।
গল্প প্রকাশিত হয়েছে — আনন্দবাজার পত্রিকার
রবিবাসরীয়, সাপ্তাহিক বর্তমান, তথ্যকেন্দ্র,
উত্তরের সারাদিন, মানভূম সংবাদ, পুরুলিয়া দর্পণ, আলো, মৈত্রীদূত,
পথের আলাপ, ইত্যাদি পত্রিকায়।
লেখককে আলোড়িত করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রাম। মানুষের ক্রমশ অবক্ষয়িত মানবিক মূল্যবোধ। সম্পর্কে বাড়তে থাকা জটিলতা।
বর্তমান ঠিকানা সিমলাপাল কুমার পাড়া, সিমলাপাল,
জেলা বাঁকুড়া।
প্রকাশিত গ্রন্থ
১)ভালোবাসা (গল্পগ্রন্থ) প্রকাশক পরম্পরা
২)হাত ধরার কেউ (গল্পগ্রন্থ)প্রকাশক সংস্কার
৩)দু কলমের গল্প (অণু গল্প সংকলন)প্রকাশক অন্যপথে
৪)শিলাবতী উপত্যকার লোকায়ত প্রত্নজীবন (বাঁকুড়া জেলার শিলাবতী নদী তীরের লোকায়ত জীবনের উপর গবেষণা গ্রন্থ)
প্রকাশক সুপ্রকাশ
৫) আরশি নগর (কবিতারবই)অন্যপথে
সম্পাদনা — গত বারোবছর ধরে গল্পলোক বলে একটা গল্পের পত্রিকা সম্পাদনা। মেঘ বৃষ্টির গল্প বলে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি গল্প সংকলন সম্পাদনা। প্রকাশক মউল
সম্মান/পুরস্কার
১)রুদ্রকাল পত্রিকা কতৃক জেলার বিশিষ্ট
সাহিত্য সেবী সম্মান ২০১৩
২)রামমোহন রায় লাইব্রেরি এবং রিডিং রুম কতৃক
রণজিৎ গুহ স্মৃতি পুরস্কার ১৪২০
৩)তরঙ্গ সাহিত্য সম্মান ২০১৬
৪)মউল সাহিত্য সম্মান ২০১৭
৫)সেই সবুজের ডাক পত্রিকা কতৃক সবুজ স্মারক
সম্মান ২০১৯
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
1 মন্তব্যসমূহ
খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যমূলক লেখা। নিচে গ্রন্থবিবরণী পেলে আরো ভালো লাগত
উত্তরমুছুন