বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়: স্মৃতির সরণী বেয়ে
মানস শেঠ
২০১০ এর চৈতালি ঘূর্ণির সঙ্গে
সঙ্গে আমার শেষ হয়েছিল বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের বিদ্যামন্দির পর্ব। বাংলায়
মাস্টার্স করলে তখনও সার্টিফিকেট পাওয়া ঢের দেরী। আমাদের ছোট্ট বাড়ির তিনতলার দু
কামরার ঘরে তখন খুঁজছি ওই আবাসিক জীবনের নিয়মের থেকে বেরিয়ে আসা একটুকরো
অন্যছন্দকে। কলম কে তখনও সেরকম শানিয়ে ক্ষুরধার করে তুলতে পারিনি। বিদ্যামন্দিরের
ফাঁক পাওয়া সময়ে আমি তখনও ঘুরে বেড়াতাম একাডেমির পিছনের সারির সিটগুলোতে। হাতখরচ
বাঁচিয়ে টিকিট কেনা ত, তাই সামনের সারি যেতে তখনও সামর্থে
কুলোয়নি।ওইখানেই আমার নাটকের প্রতি প্রেম।
মফস্সলের মধ্যে বোধহয় একটা অসুখ মুখ লুকিয়ে থাকে। তার নাম দূরত্ব। তাই হুগলি বড়ালগলির ওই
ঘরটাতে ঢুকে গেলেও আর বেরোনো হলো না। কলকাতা থেকে গেল, ছেড়ে আসা
প্রথম প্রেমের আলতো অথচ অনুভবে গভীর একটা তীব্র অনুভূতির ভেতর। চুঁচুড়া
রবীন্দ্রভবনে আসা নাটকের দলগুলোর অভিনয় দেখছি, তাও সেটা শীতে
সারাবছর নয়। চাকরি তখনও আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে, কোনো
কলেজে গেস্ট লেকচারার পদের জন্য ইন্টারভিউ দিচ্ছি, তাদের
অদ্ভুত আবদারে সেটাও নাকচ করছি। রোজগার বলতে শুধু টিউশন। সেই সময় আমাদের বাড়ির
আরেকটু দূরে থাকত দেবরঞ্জন ভট্টাচার্য। শ্রুতিনাটক করতেন। আমি ডাকতাম বাবু দা বলে।
সেই বাবু দা একদিন বললেন, “তোর বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে
পরিচয় আছে নাকি?” আমি বাবার মুখে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের নাম
শুনলেও আমার সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় হয়নি। বাবা-জেঠুর কাছ থেকে শুনেছিলাম তিনি খুব
রাশভারী মানুষ,সবার সঙ্গে তিনি কথা বলেন না।
বাবুদাকে বলেছিলাম সেই আমার
শোনা কথাগুলো। বাবুদা ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিকই। তবে তুই একবার গিয়ে
দেখতে পারিস। দুরুদুরু বুকে বাবুদার সঙ্গেই গিয়েছিলাম। মানুষটিকে দেখে আমার প্রথম
দর্শনে মনে হয়েছিল একটা অদ্ভুত প্রজ্ঞার কাছে দাঁড়ালাম। দেখা হল প্রবীণের সঙ্গে
নবীনের। উনি জিজ্ঞাসা করলেন লিখতে পারো কিনা? তখনও আমি ভাবি
নি কলমের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হবে। রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজ ম্যাগাজিনে তখন
বেরিয়েছে সবেমাত্র সুকুমার রায় কে নিয়ে একটা প্রবন্ধ আর দুটো গল্প; তার পাঠকও বেশ কম। সে যাই হোক আমি দুরু দুরু বক্ষে বললাম “সেরকম নয় জেঠু”। উনি বললেন তোমার ফোন নাম্বারটা রেখে দাও,তখন
স্মার্টফোন এলেও, এরকম ঘরে ঘরে প্রতি সদস্যের একটি করে ছিল
না। এখন তো ঘরের সদস্য যতজন তার চাইতে মোবাইলের সংখ্যা বেশি। তারপর আর বৈদ্যনাথ
মুখোপাধ্যায় এর কাছে আমার যাওয়া হয়নি। চাকরির জন্য একটা চেষ্টা চরিত্র চলছে,
শিকে কিন্তু ছিঁড়ছে না।
এমন অবস্থায়, একদিন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ জেঠুর ফোন এলো। বললেন উনি নাট্য অভিধান আগেই রচনা করেছেন; সেটি আবার নতুন সংস্করণ হবে, আমি যদি তাকে সাহায্য করতে পারি তাহলে উনি খুব উপকৃত হন। রামকৃষ্ণ মিশনে পরলেও বিভিন্ন ধারার অভিধান হতে পারে সেটার সম্পর্কে আমার খুব বেশি জানা ছিল না। কি আর করা যায়, সত্যি কথা বলতে কি নাট্য অভিধান সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। হাতে তখন সে রকম কোনো কাজ ছিল না আমিও রাজি হয়ে গেলাম, উনি বললেন আমি কিন্তু তোমাকে আমার লেখক হিসেবে নিযুক্ত করলাম এবং তার জন্য আমি কিন্তু তোমাকে পারিশ্রমিক দেব। পারিশ্রমিকের ব্যাপারটায় আমার তখন কিন্তু কিন্তু লাগছিল কারন এইরকম ভাবে পারিশ্রমিক যে হয় তার কোন ধারণা ছিল না। আমিও সোমবার থেকে শুরু করলাম সন্ধ্যে ছয়টা থেকে রাত্রি দশটা অব্দি ওনার শ্রুতি শুনে লিখন।
শুনে শুনে লেখার মধ্যে একটা দারুণ উপভোগ্য বিষয় থাকে। প্রথম, কানের তীক্ষ্ণতা থাকতে হবে স্পষ্ট। বানান সম্পর্কে থাকতে হবে সচেতন। রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ার সময় ওইটুকু বোধ এবং জ্ঞান আমাদের অর্জন করতেই হতো। নাট্য অভিধান মানে একটা বিশাল ব্যাপার এটা ত সত্যিই, তার থেকেও আরও বড়ো সত্যি অচেনা অজানা মানুষজন সম্পর্কে তথ্য ভিড় করে ইচ্ছে থালায়। কলম ওনার, খাতা ওনার, শব্দ ওনার আমি শুধু শব্দ শ্রমিক। উনি প্ৰথমে শুরু করলেন, ওনার প্রথম বইয়ে কী কী দোষ ছিল, কেন উনি সবটা সফল হতে পারেননি। ওনার প্রতিবন্ধকতা কোথায় ছিল এবং কতদূর ওনাকে পড়াশোনা করতে হয়েছিল।
তখনই বুঝেছিলাম স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির বাইরেও আরেকটা
শিক্ষার জগত আছে। উনি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ব-এ 'ঈ' হয় আর
রবি ঠাকুরের ব-এ 'ই' হয়। এর কারণ
সম্পূর্ণটাই বাংলা ব্যাকরণ এর সন্ধিজাত। উদাহরণ দিয়েছিলেন 'কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়'
এর। তিনি লেখার মাঝে মাঝেই আমাকে বলতেন একটা শব্দের গঠন কিভাবে গড়ে
ওঠে। কোন কিছু লেখার সময় ‘সাথে’ না
লিখে ‘সঙ্গে’ লিখতে হয়; কখন লিখব ওপরে আর কখনো বা উপরে। গঠন অনুসারে উনি বললেন ‘ঐ’ শব্দের প্রয়োগ না করে ‘ওই’
শব্দটা লেখাটা দরকার। বহু বিচিত্র তার জ্ঞানের মহিমা। জীবনের কিছু
ফেলে আসা পথের স্মৃতিচারণা করতে করতে তিনি বলেছিলেন এ.জি বেঙ্গল এ চাকরি করতে করতে
তিনি অসংখ্য নাটক লিখেছিলেন রেডিওর জন্য। সব সংরক্ষণ তিনি করে রাখতে পারেননি।
কালের গর্ভে তা হয়তো গেছে হারিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির মঞ্চ নিয়েও ছিল
তাঁর স্মৃতিচারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়
পাস করা এক তরুণ বুঝতে পারছে তার ভিতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে এক একটা করে শিক্ষার
পলেস্তারা। যখন আমি জেঠুর কাছে যেতাম তাকে আমার ব্যক্তিগতভাবে রাশভারী মনে হলেও
রসিক মানুষও মনে হয়েছে, কিরকম? উনি হেসে হেসে
বলতেন, “শোনো এখনো আমার সুগার হয়নি অতএব আমি মিষ্টি খাব না
কেন? রসগোল্লা খেতে আমার খুবই ভালো লাগে।”
প্রতি বৃহস্পতিবার উনি যেতেন একটি সাহিত্য
বৈঠকে, সম্ভবত তার নাম ছিল বৃহস্পতির বৈঠক। তার আড্ডা ছিল বালির মোড় থেকে
ব্যান্ডেল যাওয়ার দিকে জলের ট্যাংকের কাছাকাছি একটি বাড়িতে। শুক্রবার যখন আমি
লিখতে যেতাম, তখন উনি বলতেন সমস্ত সাহিত্য বৈঠক সাহিত্য
উপাদান দিয়ে তৈরি এরকম কিন্তু ভাববে না। উনি সাহিত্য বৈঠকগুলোকে বলতেন
উৎকৃষ্টমানের ছাই, যদি ওখান থেকে কিছু রত্ন বেরোয় তাতে উনি
আনন্দিত বোধ করেন। তার সঙ্গেও তিনি বলতেন ওই সাহিত্য বৈঠকের রসালো খাদ্যের কথা,
মিষ্টি এবং চানাচুর তার বাধা।
ধীরে
ধীরে বুঝতে পারছি উনি যতটা বাইরে কঠিন খোলস দিয়ে রাখেন ভিতরে কখনোই অতটা কঠিন
নয়। উনি গল্প করে বললেন আশাপূর্ণা দেবীর কথা, সেই গল্পটা আমি এই লেখার
পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করি। আশাপূর্ণা দেবী একবার প্রচন্ড লেখার চাপ ছিল,বাড়ির সমস্ত কাজ করে উনি লিখতে বসেছেন দুপুর বেলায়। এমন সময় একজন কিছু
বিক্রি করতে এসে দাঁড়িয়েছেন আশাপূর্ণা দেবীর দরজায়। বিক্রির জন্য তিনি ডাকাডাকি
করছেন, আশাপূর্ণা দেবী সেই ডাক শুনে লেখা থামিয়ে বেরিয়ে
এলেন। লেখার কথা ভুলে তিনি গল্প শুরু করলেন। অল্প কিছু জিনিসও নিলেন, কিন্তু গল্পটা ছিল তার প্রধান। সেই বিক্রি করতে আসা মেয়েটি চলে যাবার পর
আবার লিখতে বসলেন আশাপূর্ণা দেবী। পরে তিনি অর্থাৎ আশাপূর্ণা দেবী বলেছিলেন,
আমার লেখার থেকে মেয়েটির দুঃখ অনেক পরিমাণে বেশি। তাই তার গুরুত্ব
আমার কাছে অনেক বেশি। এই কথাটা বলার পরে হঠাৎ দেখি জেঠুর চোখে জল, আমি লেখা থামিয়ে জেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎ তিনি বললেন “কই আমরা তো এরকম হতে পারলাম না, আমরা তো খালি নাম আর
সম্মান এর পিছনে ছুটলাম।” একটা অদ্ভুত নীরবতা সেই সন্ধ্যার
তরল অন্ধকার নেমে এসেছিল।
বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় একসময় বেশ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তিনি নাট্যকার হতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন গল্পকার হতে, ১৯৫৭ সালে রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি জীবনের সূচনা হয়েছিল।
কিন্তু ওই সময় থেকেই তিনি বেতার নাট্যকার রূপে নিয়মিত নাটক রচনা করতেন। এমনকি তিনি আকাশবাণী নাটকের সর্বভারতীয় পুরস্কার পেয়েছেন অনেকবার। “দেশ” পত্রিকা সম্পর্কে জানেন না এমন মানুষ নেই, দেশ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করতে পারলে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন এমন মানুষও আছেনও প্রচুর। বিভিন্ন বিশেষ সংখ্যা দেশ পত্রিকা আগেও করেছে এখনো করছে। কখনো গল্প সংখ্যা বা কোন বিশেষ কোন ব্যক্তিত্বের উপর সংখ্যা তারা প্রকাশ করেন। একসময় দেশ পত্রিকা নাটক সংখ্যা করেছিল, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় সেই পত্রিকায় নাটক লিখেছিলেন “হত্যাকারী”। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই নাটকটি নাট্য প্রেমী মানুষের কাছ থেকে তিনি যে প্রশংসা পেয়েছিলেন সে গল্প আমি শুনেছি।
কলকাতা ও হাওড়ার মঞ্চ গুলোতে তার “নার্সিংহোম”এবং “ইতিহাস” নাটক এবং দূরদর্শনে “বিদ্যারম্ভে”, “ওরা যেদিন বলবে”, “মৃত্যুর স্বাদ” বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। এই সমস্ত কিছু গল্প আমি সেই কাটানো সন্ধ্যা গুলোর মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মস্যাৎ করছি। ওনার বাড়িতে যিনি কাজ করতেন, সেই মানুষটিও এসে কখন যে চা দিয়ে যায় খেয়াল করতামই না।
আজ যখন এই স্মৃতিগদ্য লিখতে বসেছি তখন কিছু স্মৃতির কথা তো অবশ্যই বলতে হয়। না,এবারে আশাপূর্ণা দেবী নয় এবারে ধরণী ঘোষ। নাট্যমোদী মানুষের কাছে ধরণী ঘোষ একজন নাট্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ধরণী ঘোষ সম্পর্কে একটু বলেনি, তিনি নিজে কোনোদিন নাটক করেননি। কিন্তু বিশ্বনাট্যের আগ্রহী দর্শক ছিলেন। তিনি কলকাতার বাংলা এবং হিন্দি থিয়েটারের নাট্য বস্তু এবং প্রয়োগগত অসঙ্গতির কথা প্রকাশ করতেন তার সমালোচনার ভাষায়। এতে তিনি নাট্যজগতে বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। এতটাই দূরে সরে যাচ্ছিলেন নাটকের যে টিকিট বিক্রি হচ্ছে তার ওপর লিখে দিতে হচ্ছে “প্রবেশানুমতি নাট্যকেন্দ্র দ্বারা সংরক্ষিত”। অর্থাৎ টিকিট কেটে নাটক দেখা যাবে না। নাট্য প্রযোজকরা ইচ্ছা করলে যে কাউকে হল থেকে বার করে দিতে পারে অথবা ঢুকতেই দেবেন না। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করছি “এরকম ঘটনা সত্যি ঘটতে পারে?”বিভিন্ন গ্রন্থে লেখক পরিচিতি ১ |
বিভিন্ন গ্রন্থে লেখক পরিচিতি ২ |
বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় বললেন, সমালোচনা সহ্য করতে অপারগ নাট্য প্রযোজক কিংবা সমালোচনার ভয়ে ত্রস্ত আত্মবিশ্বাসহীন নাট্যগোষ্ঠী সমালোচক বিশেষ কে আমন্ত্রণ জানাবেন না স্থির করেছেন এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। যেকোনো নাট্য সম্প্রদায় এরকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আছেই। কিন্তু টিকিট কেটে নাটক দেখতে আগ্রহী সমালোচককে ঢুকতে দেবেন না এমন সিদ্ধান্ত আধুনিক থিয়েটারে পৃথিবীতে কোথাও কোন নাট্য সম্প্রদায় নিয়েছেন কিনা এ বিষয়ে জানা ছিল না। ধরণী ঘোষ এবং শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপক্ষে ছিলেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়,জোছন দস্তিদার মত মানুষজন। তারা লিখেছিলেন গ্যালিলিওর জীবনের প্রথম ছটা অভিনয়ের ৫০ শতাংশ বন্ধুবান্ধব এবং স্বজনদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সংস্থার বিশেষ নির্দেশ ছিল ওই সংরক্ষিত ৫০ ভাগ টিকিট শুধুমাত্র নাট্যকেন্দ্রের শুভানুধ্যায়ীদের কাছে পৌঁছয়। শমীক বাবু যেভাবে টিকিট সংগ্রহ করেছিলেন তাতেই তারা নাকি বাধা দিয়েছিলেন তারা ধরণী ঘোষ এবং শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় কে থিয়েটারের বন্ধু বলে মনে করেন না। তাদের বক্তব্য আনন্দবাজার প্রকাশ করেন সাতই ডিসেম্বর ১৯৮০ তে।
বিভিন্ন গ্রন্থে লেখক পরিচিতি ৩ |
মাঝে মাঝে এমন সময় আসতো আমি শুধু গল্প শুনে যেতাম মানুষটির কাছ থেকে, এই মানুষটি চলমান লিভিং লেজেন্ড। ওনার কাছ থেকে যে সমস্ত তথ্য পাচ্ছিলাম আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই মানুষগুলি তো নাট্যজগতের মহান মানুষ আমি তো তাদের অভিনয় দেখতে গেছি, তখনো বুঝিনি অভিনেতা আর মানবতার পার্থক্যটা থেকে যায়। এর মধ্যে উল্লেখ করলেন পবিত্র সরকারের কথা, ১৯ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় পবিত্র সরকার লিখেছিলেন বন্ধু মনে করিনা এই কুযুক্তিপূর্ণ চিঠিটি ছাপিয়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কলকাতা নাট্যকেন্দ্রের রথী মহারথীরা বাংলা থিয়েটারের যে ক্ষতি করলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একার পক্ষে সারাজীবনে সেই ক্ষতি করা সম্ভব হতো না। দেশের লোকেদের যে বিশ্বাস জন্মাবধি বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের বাঘা বাঘা ব্যক্তিরা কুঁদুলে এবং আত্মবিশ্বাসহীন। পবিত্রবাবু লিখেছিলেন “আমি তো দেখছি মোহিতবাবুরাই সাংঘাতিক ওজনদার করে তুললেন শমীক বাবুদের। নইলে মাত্র দুজন লোকের থিয়েটার দেখা আটকাতে এত জোগাড় জন্তর এত ব্যবস্থাপনা। শমীক প্রসেনিয়াম থিয়েটার কে বাবুদের থিয়েটার বলে গাল দিয়েছেন বলে এত জ্বালা, তা জোছন বাবুরাও যে একসময় শম্ভু বাবুদের আর রুদ্র বাবুদের নিউ এম্পায়ারে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে অভিনয়ের জন্য চুটিয়ে গাল দিতেন তার ছাপা রেকর্ড আছে। তাহলে সুবিধাবাদের কোন শুভ বিবাহের জোছন বাবুরা এখন শম্ভুবাবুদের আর রুদ্রবাবুদের কোল পান আর তার অন্যথায় শমীক বাবুদের জন্য দারোয়ান মোতায়েন করা হয়?”
বিভিন্ন গ্রন্থে লেখক পরিচিতি ৪ |
আমি
অবাক হয়ে শুনছি এত বড় ইতিহাস কিভাবে একজন মানুষ গড় গড় করে বলে চলেন। যারা সংসদ
বাংলা নাট্য অভিধান সম্পর্কে জানেন তারা জানেন বইটির গঠন বৈশিষ্ট্য কী রকম? আর যারা
জানেন না জন্য বলি শুধুমাত্র কোন ব্যক্তি বিশেষের ইতিহাস নয়, ছোট ছোট নাট্যদল, নাট্য অভিনয়ের কথা, নাটকের গল্প বিতর্ক সবকিছু মিলে অভিধান এবং অভিধান এর বাইরেও আর একটি
জ্ঞাতব্য গ্রন্থ। উনি বলেছিলেন কোন মানুষ অনেক গল্প লিখতে পারে, কবিতা-নাটক -উপন্যাস-প্ৰবন্ধ কোন কিছুরই খামতি থাকবে না। তবে সেই সব
সৃষ্টিশীল মানুষদের মনে রাখতে হবে তাদের মৃত্যুর পর কটা সাহিত্য মানুষের কাছে
বেঁচে থাকতে পারে। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম সেদিন কত বড় দার্শনিক প্রজ্ঞা তার মধ্যে
বিরাজমান। তার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বললেন একজন অভিধান রচয়িতা কিন্তু একটিমাত্র
অভিধান লিখতে ব্যয় করে ফেলেন সারা জীবন। উদাহরণ দিয়েছিলেন হরিচরণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঘোষ এইসব মানুষদের। তিনি
বললেন একদিন হয়তো তিনি থাকবেন না, কিন্তু এই নাট্য অভিধানটা
থেকে যাবে সেই অভিধান-এর মধ্য থেকে তার বেঁচে থাকা।
শুধু গল্প নয়, সেই কাটানো মুহুর্তগুলো থেকে আমি রসদ নিচ্ছিলাম একটু সাহসের। উনি একবার বলেছিলেন, তুমি বড় বড় জায়গায় লেখা পাঠাও। আমি তখন মনে মনে ভাবছি, আমার চিন্তা ওই জলফড়িং এর মতো। কলমকে বাজি রেখে দৌড় জিতবো,এরকম মিটার-দৌড় আমার দ্বারা অসম্ভব। সোজাসুজি বললাম, জেঠু বড় বড় জায়গার বড় বড় মানুষরা আমাকে দূরবীন দিয়েও দেখবে না। নাট্য অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণ এর শ্রুতি লিখনের কাজ করছি আর উনি নাছোড়বান্দা বলছেন, “তোমাকে ত কিছু লিখতেই হবে।” সেই জোর জবরদস্তি করে একটা কোনোরকমে গল্প দাঁড় করিয়েছিলাম। পড়ালাম বৈদ্যনাথ জেঠুকে দিয়ে, ভাবলাম উনি হয়তো পড়ে কোনো মন্তব্য করবেন। উনি সেটা না করে বললেন, রেখে যাও। ঠিক দুদিন বাদে,আমার গল্পটি কাটা ছেঁড়া করে অজস্র প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে কালকের মধ্যে দেবে। একেই লিখতে পারি না,তার উপর প্রশ্নের উত্তর। খুব সমস্যায় ফেঁসে গেলাম। অন্য কেউ হলে পাত্তা দিতাম না। কিন্তু উনি বলেই একটা উত্তর আমি খাড়া করে ওনাকে বললাম। উনি আমাকে আবার লিখতে বললেন, লিখলামও। পাঠাতে বললেন ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকায়। ডি.টি.ডি.সি কুরিয়ার খরচ চল্লিশ টাকা, সেটাও উনি আমাকে দিয়ে বললেন চাকরি পেলে শোধ করে দিও। প্রকাশ পেল গল্প “সুখনীড়ের কথা”। গল্প প্রকাশ পেল। সাম্মানিকও পেলাম দুইশত টাকা। বাড়িতে এলো চেক। প্রথম সন্তানের জন্ম দেবার আনন্দ তখন আমার চোখে মুখে ঝামড়ে পড়ছে।
এরপর ওনার কথা মতো প্ৰবন্ধ লিখতে শুরু করলাম। পাঠাতে
শুরু করলাম ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’এ। প্রকাশ হতে শুরু
করলো “বিশেষ রচনা” বিভাগে। অবশ্যই
পাঠানোর আগে একবার করে ওনাকে দেখিয়ে নিতাম। আমার মতো একটা আনাড়ি লোককে লেখার জগতে
সাবালক করে তুলতে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। প্রথম বই যখন বার্ণিক প্রকাশ করে,
“ধুলোর চাদর” — তার পরতে জড়িয়ে ছিল বৈদ্যনাথ
জেঠুর আশীর্বাদ। উনি একদিন বললেন কেন তোমাকে লিখে অর্থর কথা বললাম জানো? তোমাকে যদি লিখে কেউ অর্থ দেয় তাহলে তুমি বুঝবে, তোমার
লেখা লোকে টাকা দিয়ে পড়বে। সেই সম্মান তুমি অর্জন করেছ।
শুধু তাই নয়,আরেকটি ঘটনার
কথা না বললে অন্যায় হবে। আমাদের বাড়ির কাছে ফ্রেন্ডস লাইব্রেরী আছে। লাইব্রেরীর
মেম্বার আমি খুবই ছোটবেলা থেকে, মাঝখানে বেলুড় রামকৃষ্ণ
মিশনে পড়ার সময় বেশ কিছু বছর বিরতি ছিল। আবার যখন কার্ড করালাম, দেখলাম রামকিঙ্কর বেইজের জীবনী নিয়ে বিখ্যাত সমরেশ বসুর উপন্যাস “দেখি নাই ফিরে”। বইটির মূল্য যেরকম তাতে লাইব্রেরী দেবে না, এমনকি টাকা
জমা রেখে দিলেও না। রাগ হলো। গিয়ে বললাম জেঠুকে। বই থাকতে বই পড়তে পারব না,
তাহলে লাইব্রেরিতে গিয়ে কী লাভ! অন্য একটা বই যখন ফেরত দিতে গেছি,
লাইব্রেরিয়ান বললেন আপনি “দেখি নাই ফিরে”
বইটা নিতে পারেন এবং আপনার পড়ার পর ফেরত দিলে আমরা ওই বইটা সবাইকার
জন্য উন্মুক্ত করব। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় আমাদের ফোনে বলেছেন। বইটা নিয়ে বাড়ি আসার
সময়, ভাবলাম আমি কোথাকার কে? যার জন্য
ওই মানুষটা এতখানি করলো।
ওনার
যে ঘরে শীতলপাটি বিছিয়ে লিখতাম, সে ঘরে থাকত প্রচুর বই। ছড়ানো
নয়, খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা, কোনো
কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেলে উনি বলতেন ওই বইটা (আঙুল দেখিয়ে) নিয়ে এসে অমুক পৃষ্ঠার
দিকটা দেখো ত। অমুক পৃষ্ঠার দিকদর্শন কোনোদিন ভ্রান্তপথে হাঁটেনি। পেয়ে পাঠ করতাম।
এরকম অনেক টুকরো টুকরো কিছু পাঠ করতে করতে জানতে লাগলাম অনেক অজানা ইতিহাস,
অনেক মানুষের কাজ। চোখের সামনে দেখতাম পর্দা সরছে, উঠে আসছে সেইসব অজানা ইতিহাসের কথা।
কিন্তু
সব কিছুরই ত শেষ হয়, একদিন লেখাও ফুরোলো। এবার আমার নিয়মিত
যাতায়াতের পথে একটি কমা পড়ল, অনিয়মিত যাতায়াত বাড়ল। লেখার
একটা নেশা পেয়ে বসলো, গল্প-কবিতা বা উপন্যাস এ স্রষ্টা নিজের
সৃষ্টিকে রাখতে পারেন নিজের হাতে, কিন্তু প্ৰবন্ধ লেখকদের
পড়তে হয় অনেক। তথ্য লাগে অনেক। ওই কাজে যখন ব্রতী আমি, একসময়
সুদূর দিল্লি থেকে একটা ফোন এলো, “উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস”
পত্রিকার দপ্তর থেকে। একটা লেখা যদি পাওয়া যায়, বৈদ্যনাথ জেঠু নাকি বলেছে। লিখলামও সত্যজিৎ রায়ের উপর, প্রকাশ হলো।
সময়ের ডালে একসময় পাতা ঝড়ানোর উৎসব আসে, জীবনের
আয়ুতে লাগে শেষ রং। ব্যস্ততা এসে গ্রাস করে সময়ের পাঁচিলগুলোকে। ভেঙে যায় চির
পুরাতন ছন্দ। আমারও ভেঙে গিয়েছিল, শিক্ষকতার জীবনে ষোলো আনা
ব্যস্ত হয়ে পড়ায়। জেঠুর সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বাড়ছিল, কিন্তু
যোগাযোগ নিভছিল না। বয়সের ভার, সেই রসগোল্লা প্রেমী মানুষটার
শরীরকে হারিয়ে দিল গোহারা। চলে গেলেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। একরাশ বিষন্ন বিকেলে
ঝামড়ে পড়েছিল সেই তেওয়ারী পাড়ার ছোট্ট বাড়িটায়। আমিও গিয়েছিলাম। শেষ একবার দেখবো
বলে, কিন্তু শেষ নেই যে শেষ কথা বলবে কে?
এখন
আমার বিকেলগুলো বড্ড সাবালক। এখন কিছু লিখতে গেলে, আমিই আমার বিচারক। আমি আমার
সাহিত্যের ছাতা হারিয়েছি অনেকদিন, সাবালক হবার পথে হোঁচট
খেয়ে যাই। উঠি আবার, হেঁটে যাই। ভাবি, এই
হয়ত জেঠু বলবে, “এগিয়ে যাও,আমি ত আছি”
— গলার কাছটা বড্ড দলা পাকিয়ে উঠলো। চোখটা লাগছে ঝাপসা। স্মৃতিগুলি
উঁকি দিচ্ছে মনের খিড়কি পথে। বাইরে রং বদলেছে এক টুকরো আকাশ। 🚫
মানস শেঠ |
মানস শেঠের
জন্ম হুগলি শহরে ১৩৯৩ বঙ্গাব্দে। প্রাথমিক থেকে
উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা হুগলি শহরে হলেও, বাংলা
সাহিত্যে স্নাতক (২০০৮) এবং স্নাতকোত্তর (২০১০) বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির
থেকে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতা।
প্ৰবন্ধ লেখার সলতে পাকানোর ক্ষেত্র ছিল বিদ্যামন্দির পত্রিকায়। এরপর বেশ কিছু প্ৰবন্ধ প্রকাশ পায় "সাপ্তাহিক বর্তমান" পত্রিকা সহ কিছু বাণিজ্যিক পত্রিকায়। বিভিন্ন বিষয় নিবন্ধাবলী প্রকাশ পায় 'দিগন্ত', 'বার্ণিক', 'তবু একলব্য', 'নির্মুখোশ', 'চতুষ্কোণ', 'শিল্পনীড়' প্রভৃতি ম্যাগাজিনে। প্রথম প্ৰকাশিত প্ৰবন্ধ গ্রন্থ "ধুলোর চাদর"(২০১৭)এর জন্য পেয়েছেন "বার্ণিক সাহিত্য সম্মান"(২০১৮)। আরেকটি গ্রন্থ "বাংলার চড়ক ও গাজন উৎসব এবং অন্যান্য"(২০১৯) প্রকাশ পেয়েছে 'পরম্পরা'প্রকাশন থেকে।
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
0 মন্তব্যসমূহ