“নয়নে না দেখে তারে,
বিনে তারে, যারে প্রাণ সঁপিলাম”
রামনিধি গুপ্ত
বৃষ্টির হাত ধরে এগিয়ে চলেছে মেঘ
চোখের কাজল নামছে গড়িয়ে; তবে এবার—
বৈভব জমবে লবন হ্রদে
আতর মাখবে দশদিক
রূপকথা বেজে উঠবে মহাজগতের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়
এই মৌন পান্থনিবাস
সবাই ভাবছে কুসুম-চরাচরে—
নিবাসের সঙ্গে
পান্থের খেলা দেখতে দেখতে
বাহারি
মুখের দল যাবে ছুটে
কিন্তু যায় না
অমরত্বের ফাটল বেয়ে নেমে আসে
বর্ণময় জগৎ…বাজনা বাজে…বিন্দাস বাজনা
অস্থির ভিতর দেশ মাটি দখলের লড়াই
দেখতে
দেখতে
পচন ধরে জামার অন্তরে…বুকের খড়কুটোয়…
রঙিন পালকগুলি রঙ হারিয়ে উড়ে যায়
আষাড়-গম্বুজের
শরীর
থেকে…
শরীরময় গীর্জার ঘন্টা বাজছে। প্রবীন রাস্তাগুলি
গেয়ে
উঠছে তন্ত্রসঙ্গীত
আজ তবে ওঁ-কাব্যে মেতে
কীর্তিনাশা সময়ের
দিকে হেঁটে যাওয়া যাক
রামমোহন এঁকে
দিন দিগন্তের শেষ চরের
একা থাকার কাহিনী-ছবিটি…
ছবি ভেসে গেল মুনলাইট সোনাটার জলে।
আড়ালে আবডালে
ঘরকন্না সেরে মণিপদ্মের চিন্তামণি
রসিকার রসভান্ডে ভাসিয়ে দিলো
নবনায়কের
মুখ
লালন ছড়িয়ে গেলেন আনন্দবাতাসে…
দুই
কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন গ্যালাক্সির ধারা…
…প্রোটন…নিউট্রন…বিটোফেন…নিধুবাবুর টপ্পার দল
প্রাণময় শস্যকথা…কৃষাণীর বীজলিপি
এই-ই তবে মহাকাল…
আগুনের নাচ দেখে কত চিত্রকল্প হয়…সরে যায়
সম্রাটের একক শাসন…মরে যায় রঙিন কথারা
মরে গেলেও
লড়াই চলবে সেই বুনো মহিষের
যে আমায় এক আদিবাসী প্রত্যুষের কাছে নিবেদন করে
শান্তি পেয়েছিল…আতপ দুপুরে—
মুখচ্ছদ বারবার বদলে নিতে নিতে
চিনিয়ে
দিয়েছিল
পূর্বপুরুষের
উপাদেয় ঘৃতগন্ধের দিন
গন্ধের ভিতর যে ঝাপটা থাকে
তাকেই ঝড় ভেবে উড়ে যাই—
ওলোট পালোট—
স্মৃতিনগরের
দিকে
নগরের শসস্ত্র লোক। আমি কোনোদিন বুঝিনা তাদের
বুঝিনা ষড়যন্ত্রের অর্ন্তঘাত
সুদর্শনচক্রের চেয়েও কেন অনেক জটিল
জটিল আকাশ থেকে হেসে ওঠে দিব্য মেঘরা
গ্রহপুঞ্জে বেজে ওঠে সরোদ সেতার
ভাটিয়াল বাজে আকাশগঙ্গায়
ছায়াপথে কত সিঁদুর মাখানো চাল
সূর্যের লাল তাই স্মান হল বুঝি
তুলির আঁচড়ে জন্ম নিলো গোপন ঈশ্বর
শুরু হল চাঁদে চাঁদে ফিসফাস
ওপাশে দিগন্ত নেই
এপাশে জিহ্বা মেলে দাঁড়িয়েছে অতীত সময়
উঃ কী ভীষণ টান এই অস্তিত্বের ঘরে
তবু কোনো আনন্দ-প্রস্তাবের সমর্থন নেই
তিন
কয়েক মাইল বেগে হাইওয়ে ধরে চলে যায়
জানালা দরোজাদের মন…ঝাউপাতায় নবম সিম্ফনী
এ দৃশ্যের শেষে নেই কোনো চ্যানেলের লোগো
জন্ম…মৃত্যু…আদিকালের প্রেম
ধাবমানতার ভিতর
থেকে সামনে দাঁড়ালে
সবাই
ভাবে বিশ্বরূপ
কেদার-মালকৌষ-বাহার বাজে চাঁদের গায়ে
খুলে যায় ব্রহ্মান্ড পরতে পরতে
ভিতরে নিবিড় ফুটে আছে ইচ্ছাকুসুম
হাত ঘসলেই
পৃথিবীর জরায়ু কোনে কেঁদে ওঠে
কয়েক কোটি বছরের আমি
চেতনে ফাগ উড়ে রঙধনু হলে
হেসে ওঠে চিলেকোঠা
অবক্ষয়ে দগ্ধ হতে হতে এক বৃদ্ধ বিকেল
গেয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ
জীবনানন্দের জোছনায় ভিজে গেল ধানকুমারীরা
আর তখনই ঈন্দ্রপতনের শব্দে বুক ভাঙে
অনাথ
সংসারের
এবার মাথায় মাথায় আয়োজন হোক
ফ্যাশনে পাল্টে যাওয়া এই পাঁচতারা শতক
আইফোনে ভরে নিক চরিত্র বদলের যুক্তাক্ষরহীন
নতুন
ফর্মুলা
চার
বৃত্তের ভিতর বৃত্ত…তার কোষে জন্ম নিলো প্রেম
আলোবছরের প্রেম…
মোহন পাখিটি
চৈতন্যলীলায় বেঁচে থাকা পরম্পরা সোহাগ
দেহি পদপল্লব— শুনে গলে গেল
কৃষ্ণকীর্তনের
আলো
মুখোশের আড়াল থেকে মুখ এনে
মুখোশের ওপর রেখে
আড়ালে জাগানো
হল—
প্রেতসংসার
গোধুলি…গো-ধুলি…মাগো কস্তুরী-যন্ত্রণা
এ মহাপদাবলী শুনে
কেঁপে উঠছে কশেরুকা
মগজ চালিয়ে নেটে নেটে চ্যাট শুরু হল
আমার আমি-র থেকে লাটাই গুটিয়ে
অন্য আমি-র সুতোয় পড়ল টান
তারপর কানামাছি শুরু—
কপালপোড়া ছাই এনে লাগানো হলো চোখে
আলো-ঘুঙুরের সুরে দুলে উঠলেন নিধুবাবু—
এই তবে পরান্নভোজী প্রাণ। মেধার সৌরভ
রমন ও মৃত্যুকে বোড়ে গজ করে
নতুন চালের
উৎসব…
শিরায় শিরায় শয়তানের সন্তান
তাপ উঠছে তাদের মাথা থেকে
মেধার
তাপ
ঠোঁট নড়ছে না
অথচ কত টেরাকোটা কথার ভাঁজে
ভরে যাচ্ছে পাঠকক্ষের হৃদয়
হৃদয়
এক আলংকারিক শব্দ মাত্র। মেধার খুলিভাঁড়ে
বাসা বোনা শুরু…বাবুই বৈভবে।
দোয়েল-ভোর ধরে হেঁটে হেঁটে পড়ুয়া রোদের পাড়া আঁকড়ে রয়েছি…
মোড়ে মোড়ে চাঁড়ালের দল
তাদের শেখাই সব আশ্চর্য হাড়ের কাহিনি
টলটল কাদাজল
সুখী সংসার। কলেজ
ঘাটের জলছবি
কেরীসাহেবের চোখ নেচে ওঠে।
গঙ্গাফড়িং আর এলোমেলো আঁচলের আড়ালে
চর্যাপদ
দেখে
নিজেকে নিজেই তামাশা করি
দ্রাঘিমা রেখায় দোল খায়
পোষা বেড়ালের বসার ভঙ্গিটা
হেঁয়ালি-নৌকায় ভেসে যায় অশুদ্ধ গর্ভপ্রস্তাব
দিকচক্রবালে কত ইচ্ছা ঘোরাফেরা করে
কখনও উদ্বেগহীন অনন্ত ছুটির ডাক।
রঙিন সংগীত—
পাঁচ
লাল সবুজ গোলাপী গেরুয়া
পাঠশালা। মনপ্রপাতে হবে রঙিনজীবন পাঠ…
ভাসমান তমসার গায়ে টুসু গান, ভাদু গান
কালো ঘোড়াদের দাপাদাপি। এক হস্তিনীর পাশে
মহাজাগতিক যূথরাজ
টান লাগে, ব্রহ্মগণিতে, মহাজগতের বিষাদ এসে
জড়িয়ে
ধরে আপাদমস্তক
দিন যায়, প্যাকেজের হৃদয়, রাতচর্চা ভ্রমে
নিশীথিনী শব্দনিশান দেখে থমকে দাঁড়ায়
নাভিকুয়ার
সামনে
ঝাঁপিয়ে পরবার আগে হাতছানি
কৃষ্ণগহ্বর থেকে উঠে আসে অজস্র পৃথিবীর কঙ্কাল
পাখিপাড়ায় বিষাদদিনের পাশে পড়ে থাকে
পৃথিবীর বৈমাত্রেয় ভাই
আরও দীর্ঘতম প্রতিবিম্ব…অফুরন্ত নন্দীকথা
রক্তে
মিশে যায়
দু’চোখে দীর্ঘশ্বাস; তৃতীয় নয়নে পরাগ লেগেছে
রাহুপথে…কেতুপথে
প্রতিধ্বনি তার
দূরবীনে রুদ্রপলাশ…কৃষ্ণচূড়াপথ
হঠাৎ নাদব্রহ্মে গল্প বেজে ওঠে…
স্মৃতিডিঙি নেচে ওঠে ত্রিতাল ধামারে
বুকে তার শৈশবের ভোর
কত জ্বর জড়িয়ে আছে প্রাচীন কৈশোর
দৌড়ে চলেছে
পরজন্ম তার…
বিদ্যুৎ চুল্লিতে এত পূর্ণিমার নাচ
বেলোয়ারি সন্ধ্যার ছবি দেখে
পাগল রাজপথ
তবু ঘর ভেঙে ময়ূরেরদল চলে গেল
পড়ে থাকা পালক আর
প্যাকিং বাক্সের ভেতর কলেজ ক্যাম্পাসের ইয়ার্কি-দিন
স্মৃতি-কার্ণিভাল
ছাড়া কিছু নয়
ছয়
সময়-প্রান্তরে রামকিঙ্কর…গনেশ পাইনের মুখ…
প্রদীপের তেল…ধূসর চশমা আর
এক সন্ন্যাসী
পাখির ছবি…
যামিনী রায়ের চোখ কাছে এলে
ঢল নামে পাহাড়ি
নদীর…ক্যানভাসে ঝুলে থাকা
প্রতিপদের
কাছে
দ্বিতীয়ার
অদ্ভুত প্রস্তাব…সম্পর্কে…
পলি জমে…দশচক্রে
ভগবান জীবাশ্ম হ্যে
বৃষ্টিপথে বেঁধে দেন নদিবার্তা সব
নকশালবাড়ির লকারে থাকা, প্রতিবাদী মুখগুলি
জেগে উঠছে দেখে…কৃষকের লাঙল গেয়ে ওঠে
প্রলয়ের
সুর
ঝাঁকড়া চুলের গোয়েন্দাকাহিনি, রাজকাহিনি…
মন্ত্রীকাহিনি…কোটালকাহিনিরা দল বাঁধে
খুব হুল্লোর
হয়, লুকোচুপি খেলা
আনন্দ বাজে আফিমের ছোট্ট কৌটোয়
আহা দিনকাল
জগৎজননী নেশায় মশগুল
সাত
বদল হল অক্ষরের সাজ। মনখারাপের অঙ্কুর বনস্পতি হলে
মুছে যায় শ্রাবণের জামদানী সাজ…
কৃত্তিকায়—রোহিনী—মৃগশিরায়
বিহ্বল ঘুরি ফিরি…জঙ্গলপাড়ায় জন্ম হয় মাদলকাহিনীর
মা আমাদের কনকচম্পক…পদ্ম-ভাষায় দেন অক্ষরজ্ঞান
আবহমান ভাস্কর্যের নামে
রাঢ়ভূম…বরেন্দ্রভূম…জন্মভূমে
স্বপ্ন বিক্রয়
আশ্চর্য কনকনে প্রতিকার প্রস্তাব
অদূরেই ভাপ উঠছে আলিঙ্গন থেকে
তলপেটে কলকল তন্ত্রকাহিনী
বাকিটা ভাবন-নদীর অতলে…
থই থই পুরোনো কাগজের বুকে স্বগতোক্তির
মায়াকাহিনীরা
সামনে ঘাসজমি…মায়াকাল পড়ে আছে ঘাসের নিচেই
সম্মান লেগে আছে ভাঙা কলসীর মুখে
সম্পর্ক ভৈরবী দাঁড়িয়ে জানলায়
এ তবে মৃত্যু নয়, জন্মের মহড়া মাত্র!
কিন্তু মৃত্যুই যে প্রথম প্রেম
কৃষ্ণচূড়ার নীচে রাধাচূড়ার লুকোচুপি আলো
প্রেম নয়, ভূমিকার ভূমি মাত্র ক্রয়
অবশিষ্ট কার নিজস্ব গুহায়
বয়ে যায় বিদ্যাপতি হাওয়া
দেখি ছায়াটিও উধাও আজ
এত শাপ…গর্ভ উপত্যকায় বৃথা তৃষ্ণা এত!
পিতাকে ধর্ম ভেবে ঝলসে উঠি ধানক্ষেতে ক্ষেতে
স্বর্গ ভেবে ভিড়ে যাই পানপাত্রের রঙিন নির্জনে
চাবুকের শব্দ ওঠে
শুরু হয়
এলিমিনেশন
রিয়্যালিটি শো-এ আমার চোদ্দপুরুষ
প্রশ্নের উত্তর
দেন
এক নীলকন্ঠপাখি উড়ে আসে সাক্ষাৎকার নিতে
আমি এক মিথোজীবী…কবিতার ক্লাসে নিজেকে
চুরমার করি…যতিচিহ্ন বসাই এনে আমাদের
চারপাশে
আট
কত বিষন্নমাসে চিঠিঘরে মেঘদূত রেখে যায়…
মিলন প্রস্তাব
শুনে
কৃষ্ণকথায় নেবে গেছি কালিন্দীর জলে
জলে ওপর সংখ্যাহীন রক্তকণিকা
কণিকা-জীবন অলীক রহস্যের বশ
ইচ্ছারা হাত মেলে আছে
চৌরাশিয়ার বাঁশি লুকিয়ে রেখেছে কত
কান্নার বীজ
কে কাকে কোথায় খোঁজে
ফেড্রিকনগর থেকে গোবিন্দপুর
এদিক ওদিক কত খেলনা-জীবন
ছাপাখানার ফিসফাস…মিথপথে জলছবির হাট
শাস্ত্রবাক্য পড়ে আছে আশশ্যাওড়ার বনে
এবার সব অমোঘ মৃত্তিকা গড়ে দেবে
অক্ষয় অবতার জীবন
আমার চতুর্ভূজ সুনীল শরীর
কোনো দ্রাক্ষাপল্লীর হিন্দোল-হাওয়ায়
বৌদ্ধসন্ন্যাসী দেখবেন—
হুং-মন্ত্রে বেজে উঠছে সময়-কীর্তন
আর সব অচেনা রাত্রি স্বপ্ন আঁকছে
জন্মান্তর নামক আবছা পর্দাটির গায়ে…🚫
কবি রামকিশোর ভট্টাচার্য |
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
3 মন্তব্যসমূহ
মনে হল দীর্ঘ টানেলের মধ্যে দিয়ে একটা ট্রেন চলে গেল আলোর উৎসের দিকে।
উত্তরমুছুনকবির কাব্য বিন্যাস ও শব্দ নির্মাণ সব সময়ই মুগ্ধ করে। এই কবিতা তার ব্যতিক্রম নয়। দীর্ঘ এই কবিতাটি কাব্য সুষমায় উজ্জ্বল। এই কাব্য মধুরতায় ডুবে পাঠক অন্য এক জগতে পৌঁছে যান। আমিও তাই।
উত্তরমুছুনচমৎকার কাব্যিক পরিবেশন মুগ্ধ করলো।
উত্তরমুছুন