ডাঃ অক্ষয় কুমার আঢ্য
(প্রবন্ধে লেখক অনুসৃত বানান রাখা হয়েছে)
আমাদের চুঁচড়ো শহরের প্রায় পাশেই — গঙ্গা পেরোলেই ছিল রঙ্গলাল মুখুজ্যের বাড়ী। কে রঙ্গলাল — সে কথা পরে বলব — তবে, আপনার যদি গল্প-উপন্যাস পাঠের অভ্যাস থাকে, তাহলে এই নামটি আপনার অপরিচিত নাও মনে হতে পারে। রঙ্গলাল মুখুজ্যে — ডাক্তার। কোন মেডিক্যাল স্কুলে না পড়াশোনা করেই, নিজ অধ্যবসায়ে নিজেকে গড়ে নেওয়া অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার। শুধু ডাক্তার নন — বীরভূমের লাভপুর অঞ্চলের একদা ‘ডাক্তার বিধান রায়’।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশিষ্ট এবং রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ও অ্যাকাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত উপন্যাস ‘আরোগ্য নিকেতন’ (প্রথম প্রকাশ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ) এর এক বিশিষ্ট চরিত্র এই রঙ্গলাল ডাক্তার। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র জীবন দত্ত বা জীবন-মশায়ের জীবন দর্শন উপন্যাসটির উপজীব্য হ’লেও — তারই পাশে এই অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারটির চরিত্রও পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। একেবারে খাপখোলা তলোয়ারের মতোই তাঁর চরিত্র।
রঙ্গলাল ডাক্তারের পরিচয় দিতে গিয়ে তারাশঙ্কর লিখেছেন —
“… আর উত্তর থেকে আসেন রঙ্গলাল ডাক্তার — তসরের প্যান্টলুন, গলাবদ্ধ কোট, গলায় ঝোলানো পকেটঘড়ি। রঙলাল ডাক্তার যাওয়া-আসা করেন পালকিতে। রঙলাল ডাক্তার থাকেন এখান থেকে মাইল চারেক দূরে। এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম আলোপ্যাথি নিয়ে এসেছেন। অদ্ভুত চিকিৎসক। প্রতিভাধর ব্যক্তি। মেডিক্যাল কলেজ বা ইস্কুলে তিনি পড়েন নি; নিজে বাড়িতে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। নদী থেকে, শ্মশান থেকে শব নিয়ে এসে গ্রন্থের নির্দেশ অনুসারে কেটে অ্যানাটমি শিখেছেন। বিস্ময়কর সাধনা। তেমনি সিদ্ধি। কোথায় বাড়ি হুগলী জেলায়, সেখান থেকে এসেছিলেন এ জেলায় রাজ হাই ইংলিশ ইস্কুলে শিক্ষকতার কর্ম নিয়ে। ইংরিজীতে অধিকার ছিল নাকি অসামান্য। আর তেমনি ছিল আগাধ আত্মবিশ্বাস। … তিনি হঠাৎ কোনো আকর্ষণে ময়ূরাক্ষী তীরে নির্জন একটি গ্রামে এসে এই সাধনা করেছিলেন তপস্বীর মতো। তারপর একদিন বললেন — এইবার চিকিৎসা করব। এবং কিছুদিনের মধ্যেই এ অঞ্চলে অসামান্য প্রতিষ্ঠা অর্জন করলেন। রঙলাল ডাক্তারের চিকিৎসার খ্যাতি রঙলাল-কেই প্রতিষ্ঠা দেয়নি — তার সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিরও প্রতিষ্ঠা করেছিল। চারিদিকে নতুন চিকিৎসার প্রতি মানুষ শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে শুরু করলে।…”
এ’তো গেল রঙলাল ডাক্তারের অধ্যবসায়ের একটি দিক। উদ্দেশ্যের প্রতি নিষ্ঠা — আর চরিত্রের দৃঢ়তা। তার ছায়া পড়েছিল তার অবয়বেও। তারাশঙ্কর লিখেছেন — “চেহারাতেই যাঁরা প্রতিভার স্বাক্ষর নিয়ে আসেন তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। এসব মানুষ দুঃসাহসী হবেই। … হুগলী জেলার এক গ্রামে সেকালের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। হুগলী ইস্কুলে এবং কলেজে এফ এ পর্যন্ত পড়ে বাপের সঙ্গে মনান্তরের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কলেজে পড়বার সময় তিনি হুগলীর মিশনারিদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন; তাদের ওখানে যেতেন, তাদের সঙ্গে খেতেন, বাপের সঙ্গে মনান্তরের হেতু তাই।
বাপের মুখের উপরেই বলেছিলেন — জাত আমি মানি না। ধর্মকেও না। তাই ওদের ওখানে ওদের সঙ্গে খাওয়া আমি অপরাধ বলে মনে করি না। আর ধর্মই যখন মানি না তখন ধর্মান্তর গ্রহনের কথাই ওঠে না। …”
এইবার পাঠকের নিশ্চয়ই
ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। উপন্যাসের একটি চরিত্রকে নিয়ে এতো মাতামাতির তো কোন মানে হয়
না। তারাশঙ্কর তাঁর মনের মতো করে একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন — ব্যস। মিটে গেল — সেটি নিয়ে এত বাগাড়ম্বর কেন?
— ঠিক। কিন্তু রঙলাল ডাক্তার তো কল্পনা জগতের সৃষ্ট চরিত্র নয় — তিনি ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ। অতএব এইবার রঙলাল ডাক্তার বা রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের পরিচয়টি দেওয়া যাক।
চুঁচুড়া-চন্দননগরের অপর পারেই শ্যামনগর। শ্যামনগরের কাছেই রাহুতা গ্রাম। এই রাহুতা গ্রামেই রঙ্গলালের জন্ম — ১২৫০ বঙ্গাব্দের ২৪শে আষাঢ়। অর্থাৎ ইংরেজী ক্যালেন্ডারের ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দের ৯ই জুলাই।
তাঁর পিতার নাম বিশ্বম্ভর মুখোপাধ্যায়। এই মুখোপাধ্যায় বংশটি খড়দহের ‘মুখুটি’ কুলের সন্তান — এঁদের পূর্বপুরুষের নাম কামদেব পন্ডিত। এই মুখুটিরা চারটি সেল-এ বিভক্ত ছিলেন — ফুলে বা ফুলিয়া, খড়দহ, বল্লভী এবং সর্বানন্দী।
অর্থাৎ রঙ্গলালের বংশটি যে
কুলীন ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রঙলাল ডাক্তার প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত পত্রে —
শ্রীযুক্ত ব্যোমকেশ মজুমদারকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন —
“রঙলাল ডাক্তার সত্যকারের মানুষ। তিনি সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ
মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ সহোদর। তাঁর Indian Herbs বা ঐ জাতীয়
নামের পুস্তক আছে।” (শ্রীযুক্ত ব্যোমকেশ মজুমদারকে লিখিত তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্র। তারিখ ১৩। ৮। ৫৬)
সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ
মুখোপাধ্যায়ের নামও নিশ্চয়ই আপনাদের শোনা আছে। ‘ডমরুচরিত’,
‘কঙ্কাবতী’, ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের ‘ননসেন্স রচনাশৈলী’র সম্ভবত তিনিই পথিকৃৎ। রঙ্গলালের
চেয়ে তিনি বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন।
কাজেই রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের
জন্ম ২৪ পরগণার রাহুতা গ্রামে — হুগলী জেলার কোন গ্রামাঞ্চলে
নয়। তারাশঙ্কর (জন্ম ১৮৯৮, যিনি রঙ্গলাল অপেক্ষা বয়সে
পঞ্চান্ন বৎসর ছোট ছিলেন) হয়তো এই তথ্যটি জানতেন না অথবা উপন্যাসে তথ্যটির
পরিবর্তন করেছিলেন। তবে হুগলীর ইস্কুলে এবং কলেজে তাঁর পড়াশোনা করার প্রসঙ্গটি
অসঙ্গত ছিল না।
আগেই বলা হয়েছে শ্যামনগরের
প্রায় বিপরীতেই; গঙ্গার পশ্চিমতটে হুগলী-চুঁচুড়া। রঙ্গলালের
জন্মের মাত্র সাত বছর আগেই সেখানে শুরু হয়েছে ‘হুগলী কালেজ’। আর
হুগলী কালেজের সঙ্গেই ছিল কলেজিয়েট স্কুল। খাতায় কলমে সেটি বিধিবদ্ধ হয় — ১৮৪৬
খৃষ্টাব্দে। আর ছিল ‘ডফ্ সায়েবের ইস্কুল' বা Chinsurah
Free Church Institution’ সেটির সূচনা — প্রচলিত
ধারণা অনুসারে ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে। অর্থাৎ সেই সময়ে রঙ্গলালের বয়স মাত্র ছ’বছর।
আর একটি ইস্কুল স্থাপিত
হয়েছিল হুগলী শহরে। তার নাম ছিল — ‘জমিন্দারী স্কুল’ বা Subscription School. জজ সাহেব শ্রিযুক্ত ডেভিড
কারসাইকেল স্মিথের (Mr Dc Smith) উদ্যোগে এবং শ্রী
দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ মুন্সী, বর্ধমানের
রাজা মহাত্ব চাঁদ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গের অর্থ সাহায্যে এই বিদ্যালয়টি
স্থাপিত হয় ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে। পরে ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে হুগলী কলেজ স্থাপিত হলে এটি
হুগলী কলেজেরই একটি শাখা স্কুল বা Hooghly Branch School নামে
পরিচিত হয়। অবশ্য আর একটি ইংরেজী বিদ্যালয়ের কথা এই প্রসঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
সেটি ভদ্রেশ্বর তেলিনী পাড়ায় জমিদার অন্নদা প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থাপিত
ইংরেজী বিদ্যালয়। এটি তিনি মিশনারী আলেকজান্ডার ডাফের অনুসরণে ১৮৩৯ সালে স্থাপন
করেন। এই বিদ্যালয়টিতে শ্যামনগরের বহু ছাত্র গাডুলিয়া খেয়া ঘাট পেরিয়ে পড়তে আসতেন।
তবে সেই স্কুলে কোন মিশনারী সংসর্গের ব্যাপার ছিল না। এবং যে সব ছাত্ররা ভালোভাবে
ইংরেজী শিখতে চাইতেন — তাঁরা হুগলী কলেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
বিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসতেন। এমনকি ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় যিনি কিছুদিন ডাফ
স্কুলে পড়ার পর শারীরিক কারণে পড়া ছেড়ে দিয়ে এই তেলিনী পাড়ার স্কুলটিতে বছর খানেক
পড়েছিলেন — তিনিও সম্ভবতঃ স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতিতে সন্তুষ্ট
না হয়ে, পুনরায় ফিরে এসেছিলেন ডাফ স্কুলে।
কাজেই রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের
প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষাটি উপরোক্ত হুগলী-চুঁচুড়ার তিনটি স্কুলের যেকোন একটাতেই
হওয়া সম্ভব ছিল। তবে তারাশঙ্কর যে ‘মিশনারী’ সংসর্গের ইঙ্গিত দিয়েছেন — সে টি সত্য হলে রঙ্গলালের
ডাফ সায়েবের স্কুলেরই ছাত্র হওয়ার কথা। বিশেষতঃ তাঁর অনুজ — ত্রৈলোক্যনাথ
তো ডাফ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন — কাজেই মনে হয়, রঙ্গলালও ডাফ স্কুলেই পড়াশোনা করেছিলেন এবং সময়টা ঊনবিংশ শতকের
দ্বিতীয়ার্দ্ধে — যখন বঙ্কিমচন্দ্র পড়াশোনা শুরু করেছেন
কলিজিয়েট স্কুলে।
‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে উল্লেখিত হয়েছে — রঙলাল ডাক্তার হুগলী
কালেজে F.A. পড়েছিলেন। কিন্তু হুগলী কলেজের রেজিষ্টারে তাঁর
নামটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় নামে কয়েকটি নাম অবশ্য পাওয়া গেছে —
তবে তাঁরা অন্য লোক। মনে হয়, রঙ্গলাল কলেজের
পড়া শেষ করে উঠতে পারেন নি।
আসলে তাঁর পরিবারের আর্থিক
স্বাচ্ছন্দ্য তো তেমন ছিল না। তার উপর গ্রামে ছিল প্রচন্ড ম্যালেরিয়ার দাপট। এই
জ্বরে তাঁর পিতা এবং পিতামহী এবং মাতা প্রায় একই সঙ্গে ১৮৬২ সালে পরলোকগমন করেন।
রঙ্গলালের বয়স তখন ঊনিশ বছর এবং ত্রৈলোক্যনাথের চোদ্দ বছর। আর তাদের নীচে আরও
চারটি ভাই। তাছাড়া সংসারে রয়েছেন তাঁদের পিতার জ্যাঠাইমা এবং মায়ের একজন পিসী। পরিবারের
আয়ের উৎস জমিজমা যেটুকু ছিল — ১৮৬৪ সালের ঝড়ে সবই প্রায় নষ্ট
হয়ে গেল। অতএব, সংসারের অভিভাবক — এই
দুই ভাইকেই তো সংসারের হাল ধরতে হবে। বছর খানেক পরে, ১৮৬৫
খৃষ্টাব্দে ত্রৈলোক্যনাথ গৃহত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন।
মনে হয়, এই সময়েই রঙ্গলাল শিক্ষকতার চাকরী নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন বীরভূমে। এবং
সেখানে পেশায় সাফল্য অর্জন করবার পর আত্মীয় স্বজনকেও রাহুতা গ্রাম থেকে নিজের কাছে
নিয়ে গিয়েছিলেন। এই তথ্যটি জানতে পারা যাচ্ছে ‘বঙ্গভাষার
লেখক’ গ্রন্থ থেকে। সেই গ্রন্থে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের
জীবনের বিবরণ লেখা আছে — “পাবনায় নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ও
ডাক্তার হরিশচন্দ্র শর্ম্মার সহিত আলাপ হয়। ইঁহারা দুই জনেই আমাকে যথেষ্ট আদর
করিলেন। রাখালবাবু আমাকে খরচ দিয়া বাটী পাঠান। তখন বাটীতে কেহই ছিলেন না। বীরভূম
জেলায় জ্যেষ্ঠ সহোদরের নিকট সকলেই ছিলেন। বাটী আসিয়া আমার স্ব-বিকার হইল; কোনরূপে রক্ষা পাইলাম।”
* * *
তারাশঙ্করের রাখাল ডাক্তার
ছিলেন অবিবাহিত, চিরকুমার। কিন্তু বাস্তবের রঙ্গলাল
মুখোপাধ্যায় বিবাহ করেছিলেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি ষোল আনা সার্থকতা লাভ
করেছিলেন। এই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে তিনি আর একটি বিশিষ্ট কর্মে ব্রতী
হয়েছিলেন। তাঁর মধ্যম ভ্রাতা সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথের সহযোগীতায় তিনি বাংলা ভাষায়
‘বিশ্বকোষ’ সঙ্কলনে ব্রতী হয়েছিলেন। এর
প্রাথমিক অংশটুকু ২৪ পরগণা থেকে ছাপা শুরু হয়। তবে কাজটি তিনি শেষ করতে পারেন নি।
কারণ দেখা যাচ্ছে প্রাচ্যবিদ্যা মহার্ণব শ্রী নগেন্দ্র নাথ বসু ত্রৈলোক্যনাথের
কাছ থেকে নাম মাত্র মূল্যে বিশ্বকোষের প্রথমাংশটি কিনে নিয়ে — কাজটি সম্পূর্ণ করে, বঙ্গসাহিত্যে অক্ষয়কীর্তির
অধিকারী হন।
রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের
চরিত্রের আর একটি দিক হল তন্ত্র সাধনার প্রতিনিষ্ঠা। যদিও তারাশঙ্কর রঙলাল
ডাক্তারের জবানীতে প্রকাশ করেছেন — ডাক্তার ধর্মকর্ম মানেন
না।
তারাশঙ্কর লিখেছেন রঙলাল
ডাক্তারের কাছে এই শৌখিন তান্ত্রিকের বিড়ম্বনার কথা। তার কঠিন যকৃতের ব্যাধি।
ডাক্তার মদ খেতে বারণ করেছিলেন।
“বলেছিলেন — ‘মদ খেলে বাঁচবে না। মদ ছাড়তে হবে।’
রোগী বলেছিল — ‘কিন্তু আমার সাধনভজন?’ রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন — ‘বিনা মদে, কাঁসার পাত্রে নারকেল জল-টল দিয়ে করবে। পাঁঠা বলির বদলে মাসকলাই ছড়িয়েও তো
হয় হে।’ লোকটা জিভ কেটে বলেছিল — ‘বাপ
রে! তাহলে আর মা দেখাই দেবেন না। ও আমার মায়ের আদেশ। মা আমাকে দেখা দিয়ে বলেছেন
ডাক্তারবাবু।’ রঙলাল ডাক্তার খপ করে তার চুলের মুঠো ধরে
বলেছিলেন — ‘কী বললি? মা তোকে দেখা
দিয়ে এই কথা বলেছেন? মিথ্যে বাজী! মা মদ খায়? খেতে বলে? যে মদে লিভার পচে — সেই
মদ?”
বাস্তবে রঙ্গলাল কিন্তু
তন্ত্রসাধনার প্রতি সনিষ্ঠ ছিলেন। সেই ইঙ্গিত তাঁর সমাধি ফলক থেকেই পাওয়া যেতে
পারে।
বামুনের ছেলের কিনা
সমাধিফলক। — হ্যাঁ, এ বিষয়েও রঙ্গলাল
ডাক্তার বিশিষ্টতা দাবী করতে পারেন। জনজীবনের সান্নিধ্য পরিহার করে তিনি গড়ে
তুলেছিলেন তাঁর নিভৃত আবাস লাঘোষায়। শেষ জীবনে চিকিৎসক জীবনের আগ্রহ হারিয়ে তিনি
মন সংযোগ করেছিলেন উদ্যান পরিচর্য্যায়। চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন করলে। বলতেন —
‘ভুলে গিয়েছি।’ এ কথার উল্লেখ আছে তারাশঙ্করের
রচনায়। সম্ভবতঃ এই উদ্যান চর্চাটি ছিল তাঁর লেখা Indian Herbs গ্রন্থ রচনার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ।
নিজের মৃত্যু সম্পর্কে পূর্ণ
মাত্রায় সচেতন ছিলেন রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়। কিন্তু একটি বিচিত্র ইচ্ছার কথা অত্যন্ত
দৃঢ় ভাবে জানিয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী দেহটিকে দাহ করতে
চান নি তিনি। চেয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহটিকে সমাধিস্থ করতে। এখন কি সমাধি ফলকের
লেখাটুকুও রচনা করে গিয়েছিলেন। তাই-ই করা হয়েছিল।
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই
নিদের্শিত স্থানে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সে সমাধি নাকি এখনও আছে।
নিতান্ত অবহেলায় — জীর্ণ। সমাধিফলকটি কিন্তু এখনও আছে
সমাধিতে। তাতে লেখা —
“ওঁ
তারা
দয়াসিন্ধু মহাযোগী ‘বিশ্বকোষ’ প্রবর্তকঃ।
জীয়াচ্চিরং রঙ্গলালো হৃদয়ে বিশ্ববাসিকম্।।
রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়
আবির্ভাব : গ্রাম রাহুতা জেলা ২৪ পরগণা
২৪শে আষাঢ় ১২৫০
তিরোভাব : ১৭ই কার্তিক ১৩১৬ বঙ্গাব্দ।।”
১৮৪৩ খৃষ্টাব্দের ৯ই জুলাই থেকে ১৯০৯ সালের ৩রা
নভেম্বর — এই ছেষট্টি বছর ব্যাপী ছিল তাঁর মহাজীবনের ব্যাপ্তি। কিন্তু এই জীবনকালেরই
মধ্যে তাঁর অন্তর্নিহিত প্রাণসত্তার প্রকাশ ঘটেছিল নানা দিকে — একজন সফল ইংরাজী শিক্ষক। নিজ অধ্যবসায়ে স্বশিক্ষিত চিকিৎসাবিদ এবং সেই
বিদ্যায় পূর্ণ সাফল্যলাভ। বিশ্বকোষ সংকলনের সূচয়িতা, ভারতীয়
গুল্ম সংক্রান্ত বিশিষ্ট গ্রন্থ প্রণেতা এবং তন্ত্রসাধক যোগীপুরুষ। — এ সমস্তই তো হল প্রতিভার লক্ষণ। প্রতিভাবানেরাই এ রকম বিচিত্র বিষয়ে
সিদ্ধিলাভ করতে পারেন। 'রঙলাল ডাক্তার'ও করেছিলেন।
কিন্তু আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে
থাকা এসব মানুষের খবর আমরা ক’জনই বা রাখি।🚫
২) হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা। ডঃ অক্ষয়কুমার আঢ্য।
৩) ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বঙ্গভাষার লেখক – প্রথম ভাগ। শ্রী হরিমোহন মুখোপাধ্যায়।
৪) ভদ্রেশ্বর অঞ্চলের ইতিবৃত্ত। শ্রী শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
৫) রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়। প্রলয় ভট্টাচার্য।
ব্যারাকপুরের সেকাল একাল, ২য় খন্ড।
সম্পাদনাঃ কানাইপদ রায়।
৬) শ্রী ব্যোমকেশ মজুমদারকে লিখিত শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ব্যক্তিগত পত্র।
৭) গ্রন্থ পরিচয়। আরোগ্য নিকেতন।
৮) রচনাবলী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ১০ম খন্ড। মিত্র ও ঘোষ।
ডাঃ অক্ষয়কুমার আঢ্য |
আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা বিশেষত হুগলি-চুঁচুড়ার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে
ডাঃ অক্ষয়কুমার আঢ্যের নাম সুপরিচিত। স্বাধীন পেশায় যুক্ত থেকে অর্জন করেছেন একাধিক
প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি। সংস্কৃতি প্রেমী এবং সমাজ কল্যাণ কর্মী হিসেবে নিজের শহরে শুধু
নয়, জেলাতেও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। যুক্ত আছেন বিভিন্ন লোকহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ
হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা প্রথম খন্ড
হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা দ্বিতীয় খন্ড
হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা তৃতীয় খন্ড
হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা চতুর্থ খন্ড
কালের কপোল তলে (প্রবন্ধ)
রঙ্গনটির ইতিকথা (উপন্যাস)
প্রথম অগ্নি (উপন্যাসিকা)
পঁচিশে পঁচিশ (গল্প সংকলন)
ভূতের কেত্তন (নাটক)
অরণ্যের অভিশাপ (নাটক)
কাল চলে গল্প বলে (আখ্যায়িকা)
সম্পাদিত গ্রন্থসমূহ
চুঁচুড়ার সঙ্গীত ঐতিহ্য ও অন্যান্য, স্মৃতির আকাশ থেকে, চাঁদরাণী,
হুগলী জেলার সেকাল একাল (প্রথম খন্ড)
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
1 মন্তব্যসমূহ
বাহ্। বাস্তব চরিত্র আর উপন্যাসের চরিত্রকে একসঙ্গে দেখা গেল।
উত্তরমুছুন