সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার গল্প ৯

সামাজিক দূরত্ব

শতদ্রু মজুমদার

আচ্ছা, লকডাউন মানে কী রে?

খইনির চুন উড়িয়ে বিজ্ঞের মতো মহাদেব বলল, —লকডাউন মানে হচ্ছে তালাবন্ধ।

একটু ভেবে বললাম, — তাহলে এই যে হাঁটাচলা করছি দেদার খালি রিকশা চালাচ্ছি এটা তো বে-আইনি পুলিশের ডান্ডা পেটাও তো খাচ্ছে অনেকে।

আমি নিজেও তো খেয়েছি রথতলায়।

আরে হ্যাঁ তোর-আমার রুজিতে তালাবন্ধ।

এসব আর কদিন চলবে?

জানি না টি ভি-তে তো বলছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।

সেটা আবার কী জিনিস?

কেউ কারোর মুখ দেখবে না নিজের বউ-বাচ্চা ছাড়া তোর তো আবার তাও নেই একটা বিড়ি আমার কাছে একটাই বিড়ি ছিল। মহাদেবকে দিয়ে দিলাম।

কালীতলায় আজ গরিব মানুষদের ভোগ খাইয়েছে। সেখানে কেবল রিকশাওয়ালারাই নয়, অনেক অটো-টোটো চালকরাও ছিল। কী করবে? না খেয়ে আর কদিন থাকবে? রোজগার-পাতিতে ধামা চাপা পড়ে গেল। অনেকে আবার রিকশায় টোটোয় আলু-পটল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। 

       লম্বা ধোঁয়া উড়িয়ে মহাদেব বলল, — শনিবার বান্ধব সমিতিতে আছে।

জানি।

তা তো জানবিই।

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, এ কথা বলছিস কেন?

আকাশের দিকে তাকিয়ে মহাদেব বলল, ইচ্ছে হলো তাই বললাম।

বলেই খ্যাকখ্যাক হাসি। আমি আর ওর দিকে তাকাই না। হারামিটার এইসব রকম-সকম দেখলে গা পিত্তি জ্বলে যায়।

       এমনি দিনেই পুব পাড়ার মোড়ে ভাড়া খুব কম। এখন তো আরও। বাড়ি যাবো কিনা ভাবছি, এমন সময় মুখে রুমাল-বাঁধা একটা বউ সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ভাড়া যাবেন?

কোথায়?

পার্বতীপুর।

একশো টাকা ভাড়া লাগবে।

দেবো।

    আমি হ্যান্ডেল ঘোরাতে যাবো, মহাদেব বলল, পারবে? না কি আমি যাবো?

    বললাম, তুই চাইলে যেতে পারিস     তবে আমি পারবো।

যাও তাহলে

বেমক্কা বউটা বলে উঠল, না না আপনিই চলুন

বলেই রিকশায় উঠে বসল। ভাববার বিষয়। বেশিরভাগই তো ইয়ং রিকশাওয়ালাদের চায়। এ দেখছি উল্টো। বুড়ো চালককে পছন্দ করল।

       পাক প্যাডেল ঘোরাতেই বউটা বলল, আপনার কি কষ্ট হবে? 

       না।

তাহলে ওকে চালাতে বললেন কেন?

ওর পরিবার আছে পয়সা-কড়ির বেশি দরকার।

ও! আপনার বুঝি দরকার নেই?

আছে। কম একা থাকি তো

একা কেন? বিয়ে করেন নি?

করেছিলাম।

মারা গ্যাছে?

আমি অবিশ্যি তাই মনে করি  

আপনার যদি আপত্তি থাকে, তাহলে বলতে হবে না।

আমি বলেই দিলাম, সে মাগি একজনের সঙ্গে ভেগেছে

ছিঃ নিজের বউকে কেউ মাগি বলে?

কী বলবো দশ মাসের ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেকে ফেলে যে চলে যেতে পারে

আহা! বাচ্চাটা এখন কোথায়?

এক দিদিমণি নিয়েছে।

সে এখন কত বড়ো?

বছর তিনেক হবে।

আপনার সঙ্গে দেখা হয়?

না। শিবপুরে চলে গেছে।

জোড়হাটের মোড়ে একটু থামলাম।

কী হলো?

একটু জল খাবো।

অমনি সে বলে উঠল, — আমার কাছে বোতল আছে দোবো?

না। এই তো সামনেই কল।

যান         তাহলে!

বউটা কি মনে কষ্ট পেল? কথা শুনে তো তাই মনে হয়।

       ছোটোবেলায় মার কাছে গল্প শুনেছি, কোন দেবতা নাকি মানুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে এক গরিব মাঝির নৌকায় উঠেছিল দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য মাঝিকে বরও দিয়েছিল! সেই রকম কিছু নয় তো! কথাবার্তা অবিশ্যি একটু অন্য ধাঁচের। বিশ-বাইশ বছর রিকশা চালাচ্ছি এমন প্যাসেঞ্জার দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। দরদ দূরের কথা রিকশাওয়ালাদের মানুষই মনে করে না। গাড়ি থামিয়ে, মিষ্টির দোকান থেকে দিব্বি খেয়ে চলে আসে আমাদের জন্যে ভুলেও একটা সিঙাড়া আনে না বাবুরা। হামেশাই হয়। 

       প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলি, পার্বতীপুরে কে আছে?

আমার মেয়ে।

মেয়ের বাবা?

দশ বছর কোনও খোঁজ নেই।

ঝট করে বলে দিলাম, এমন বউকে ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করলো?

কী করে জানলেন, আমি ভালো? 

রিকশা চালিয়ে বুড়ো হয়ে গেলাম মানুষ চিনবো না?

আমার কপাল! তিন বছর ঘর করেও তো চিনলো না!

বললাম, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিগ্যেস করবো?

কী? 

আপনার চলে কী করে?

মেয়ে কিছু দেয় আমি সেলাইয়ের টুকটাক কাজ করি চলে যায় যা হোক আর তো কটা দিন!

আমি চুপ। দেখে বেশি বয়স মনেই হয় না তার মানে বেঁচে থাকার ইচ্ছে আর নেই? হতে পারে। কার মনে কী আছে, বোঝা মুশকিল।

       এখানকার রাস্তা খুব খারাপ। সিট থেকে নেমে নেমে টানতে লাগলাম। বউটা বলল, — আমি কি নেমে যাবো? 

না না নামবেন কেন? 

আপনার টানতে কষ্ট হচ্ছে তো!

অতগুলো টাকা ভাড়া নেবো একটু কষ্ট করতে পারবো না? 

টাকাটাই কি সব ?

আজকের দিনে টাকাই সব পঞ্চাশ পয়সার জন্যে মারপিট শুরু করে দেয় কত ভদ্রলোকেরা!

দাঁড়ান দাঁড়ান

বলেই সে রিকশা থেকে নেমে গেল। আমার পাশাপাশি হাঁটছিল, বললাম একটু তফাতে থাকুন পুলিশ দেখলে ঝামেলা করবে।

সে ফিক করে হেসে বললে, — সামাজিক দূরত্ব? 

ওই আর কি!

বললাম বটে, কথাটার ঠিক কী মানে, আমি নিজেই জানি না। তবে লোকমুখে শুনেছি। কাগজেও লেখে নাকি! বউটা বললে, টিভিতে হরদম বলছে  

হবে হয়তো!

হবে কেন? আপনি টিভি দেখেন না? 

আমার টিভি নেই বউ নিজের পয়সায় একটা কিনেছিল নিয়ে গেছে  

ও!

একটু ভেবে বললে, কম দামে পুরনো টিভি কেউ বিক্রি করলে আপনাকে জানাবো, কেমন?

কোনও দরকার নেই দুবেলা খাবারই জোটে না

মোবাইল ব্যবহার করেন তো? 

না।

আমার একটা পুরনো আছে ব্যাটারি পালটে নিলে চলবে।

না না ওসব আমার লাগে না আর কাকেই বা ফোন করব?

অনেক রিকশাওয়ালারই তো আছে।

জানি। 

এখানে থামান  

একটা মোড়ের মাথায় রিকশা থামালাম। কিন্তু কোন বাড়ি? এখানেই তো বলরাম গলি। মানে খারাপ পাড়া। মহাদেবের মুখে অনেক শুনেছি। ওর যাতায়াত ছিল। এখনও বোধহয় আসে। 

এটা রাখুন।

হাত বাড়িয়ে নোটটা নিলাম। চারদিকে আবছা অন্ধকার। মনে হচ্ছে একশো টাকার নোট। দেশলাই জ্বালাবো কিনা ভাবছি, সে বলল, আপনি কি ঘন্টা খানেক থাকতে পারবেন? তাহলে আপনার রিকশাতেই ফিরবো।

বললাম, অসুবিধা নেই।

চেনতালা আছে? ঘরে আসুন না একটু চা খেয়ে যাবেন

 না না আমি এখানে আছি একটু পায়চারি করবো সময় কেটে যাবে

আমার কথায় পাত্তা না করে সে বলল, গলিটা খুব অন্ধকার দাঁড়ান একটা টর্চ নিয়ে আসি

ডানদিকের গলিটায় মিলিয়ে গেল সে। যা ভেবেছি, তাই। বলরামগলিতেই ঢুকলো। ঝটপট হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে, হর্ণ বাজাতে বাজাতে আমি বনবন প্যাডেল ঘোরাই।  🚫


শতদ্রু মজুমদার
জন্ম  : 1959
জন্ম স্থান : আন্দুল /হাওড়া 

সাহিত্য জীবন শুরু নাটক লিখে l

প্রথম প্রকাশিত গল্প : চোর (লেখনী /চন্দননগর )

প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ :
কাঁদন নামে একজন (1987 প্রকাশক  : মাতৃ মুদ্রণ )

অন্যান্য গ্রন্থ :
আগাছার জন্ম  (১৯৯০ প্রকাশক : মাতৃ মুদ্রণ) 
জয় যাত্রায় যাও গো (১৯৯২ গোধূলি মন) 
বইমেলায় কাঁদন  (১৯৯৮ আনন্দ প্রকাশন) 
প্রশ্ন বিচিত্রা (২০০১ কেয়ার চুঁচুড়া /হুগলি) 
মরসুমের সেদিন (২০১৩ ভোলানাথ প্রকাশনী /কলকাতা) 
কাঁদনের কান্ড কারখানা  (২০১৫ রূপালী /কলকাতা )
নামমাত্র (অণু গল্প সংকলন) (২০১৭ রূপালী /কলকাতা) 
ঢেউ গুনছি (স্মৃতি কথা) ২০১৯

যেসকল পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত :
চতুরঙ্গ ,পরিচয় ,গল্পগুচ্ছ, অনুষ্টুপ, নন্দন, একুশতক, যুবমানস,  গোধূলি মন, শতানিক, দিনান্তের অন্বেষণ, সাইন্যাপস,  গল্পমেলা , পুরশ্রী, এবং সায়ক, কোরক, পথ, প্রসাদ, সাহিত্য সংস্কৃতি (আমেরিকা ), প্রাংশু (দিল্লী), আনন্দমেলা, শুকতারা, টগবগ, সানন্দা, আনন্দ বাজার পত্রিকা, আজকাল, গণশক্তি, যুগান্তর, সকাল বেলা, বসুমতী, সত্যযুগ, ভারতকথা, ভান্ডার, বঙ্গলোক, কিশোর ভারতী, দুই বাংলার গল্প (বাংলাদেশ), জ্বলদর্চি (ওয়েব), গল্প সল্প (অন লাইন) ইত্যাদি।

পুরস্কার ও সম্মান 

গল্প মেলা পুরস্কার (1999)
অন্তর্বীজ কিশোর সাহিত্য পুরস্কার (2001)


অ থ বা

নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার) 
ক্লিক করে সেই লেখা পড়তে পারেন  

 
 
 








 
 
 
 
 
 

 
আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏