মুক্ত গদ্য
“এই মেঘের নাম মনখারাপি”
শুভশ্রী সাহা
বন্দিশ
এই সব দিনে মেঘ পেয়ে বসে মনকে। এই মেঘের নাম মনখারাপি।
ঘোমটা দেওয়া শ্যাওলা মাখা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে, অন্ধকার করে দেয় চারধার। যেন ঝুপ করে
সন্ধ্যা নেমে এলো দিন-দুপুরেই। মনখারাপির মেঘ দেখে বউ-টি আনমনে বাসন নাড়ায় কলপাড়ে। ভেজা টগর মুখ
নিচু করে তখনো ভিজছে কার্নিশের শালিখের সাথে। মফস্সলের এঁদো
পুকুরপাড়ে হাঁসেদের জটলা। জল পেয়ে ফুলে উঠেছে কলাগাছের গোড়া। লেভেল ক্রসিং ধরেই
গিঁটমারা রাস্তা। তায় দুনিয়ার অ-কামের ভ্যান রিক্সা পলিথিন
সিট মুড়ে হর্ণ বাজাচ্ছে। আজ আর বিক্রি নেই তেমন। কচুরীর ডালে মাছি উড়ছে ভন ভন শব্দ
তুলে। মনখারাপির মেঘ উড়ছে, ক্রমশ ছড়াচ্ছে চারপাশে। পাশেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে দিনের রঙ। হলুদ,
ক্রমশ পীতাভ থেকে ধুসর, ধুসর থেকে কালো। ঝমঝমে
বৃষ্টির মধ্যেই বাসন্তী ছুটল বাসন রেখে আর এক বাড়ি। তার কর্মঠ
শরীরের খাঁজে খাঁজে রামকিঙ্কর বিপদজনক বাঁক। লাল শাড়ি টানটান
করে মেলতে মেলতে সন্ধ্যা নামা চুলের বউটির মনে পড়ল এই ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যেই
একদিন সে আর বিতানদা নির্জন দুপুরে…বউমা আ-য়া-য়া-য়া-য়া, বৃষ্টি আসছে! গেরস্থালীর ডাক! সে আবার ঝটপট করে দৌড় দিল নিচে…
মনখারাপির বড় দোষ, সে মনে করিয়ে দেয় যাবত স্মৃতিছবিকে…
ফেরা
সারা আকাশ জুড়ে প্রোষিতভর্তৃকার লাজুক হাসির মতো মিঠে রোদ। মাটির পরে মাটি পড়ছে, প্রতিমার কাঠামো ভরে উঠছে শাঁসে জলে রঙে। ব্যালকনিতে লতানো গাছগুলো বেশ বেড়ে উঠেছে বর্ষার পর। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে দেখছেন গোলমরিচ চুলের সাদা কালো ধনেখালি ডুরে। খুকুর এবার আসার কথা। বেড়িয়ে যাবে বাপের বাড়ির দেশ থেকে। বেড়ানো, ফেরা আর হলো কই! খুকুর একটা শেকড় এই বাপের বাড়ির মাটিতে কোথাও রয়ে গেছে না? খুকুর বিদেশী বাড়ির কিচেন গার্ডেনে লতানে পুঁইপাতা, কাগুজে লেবুর গাছ। দুনিয়ার সব খুকুদের হাতেই বাপের বাড়ির মাটি লেগেই থাকে। ওখানে সব নিপুণ হাতে সাজানোর ফাঁকে ফাঁকে খানিকটা এলোমেলো ছিটকাপড়ের ফ্রক পরা দু’চারটে গাছ সময়কে মুঠোয় ভরে নিয়ে বসে থাকে। এই মুঠোর রূপকথা মনখারাপি আঘুনিতে মোহর হয়ে খাজানা ভরে দেয়।
শুধ খুকু সময় করে ঘাস ছাঁটতে ভুলে যায়। নীল আকাশের দিকে
তাকিয়ে নিশ্চয় তাদের বেলেঘাটার বাড়ির কথা মনে পড়ে! খুকু বাজায় আহীর ভৈরো। তার
সুন্দর বাড়ির কোর্টইয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় ধৈবতের শুদ্ধ স্বরের মূর্ছনা! চোখ পড়ল
ধনেখালি ডুরি শাড়ির। আহা এই মেঘ কি সাগর পাড়ে যাবে? খুকুর কাছে! কতদিন, কতযুগ! চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল নিচে! আচ্ছা
ঋতুর কী দেশ বিদেশ আছে! খুকু জানে তো এখন শরৎকাল। পাহাড়ের দেশে
মরুদ্যানের দেশে কী গোলাপ ফোটে! আটবছর ফেরে না আত্মজা, টারম্যাকে চাকা স্পর্শ করলেই ধনেখালি শাড়ি আকাশের
জানলা দিয়ে একজিট গেটে পরিচিত মুখ খুঁজে বেড়ায়, তারপর নিচে চলে আসে। একমুঠ ট্রাঙ্কুইলাইজার জল দিয়ে খেয়ে নিলে দিব্যি আবার ঘুম এসে যায়।
ফেরা কি সত্যি যায় আর কোথাও থেকে!!
দখল
চারদিকে জল আর জল, নদী গ্রাস করে নিয়েছে আকাশকে। এ নদীতে চর নেই সর ভাসে না দুধের ভিতর। উলটে দস্যি, ব্রীজের জঙধরা জঙ্ঘাকে রক্তচক্ষু দেখায় যখন তখন! জামিলা বিবির দুচোখের গাঢ় সবজে পিচুটিতে আঁকিবুঁকি। নিচু হয়ে দেখছে খুঁজছে গহীনের প্রাণীকে। ফুলহারের জল ফুঁসছে তাও পাটের নৌকা খালাস করতে যাচ্ছে লোকে ঠেঙা দেখিয়ে জীবনকে, ভাতের গরজ বড় বালাই! মেপে দেওয়া চাল ডালে জীবন টানে কত! গত দু’বছর জন খাটতে কেউ বার হতে পারেনি। বড় গঙ্গার গর্ভে তলানি হতে হতে বেঁচে আছে শুধুই ভিটেটুকু। ফুলহারের বড় বড় গরাসে এদিকের পাড় আকাশ ছোয় ছোঁয়। সকিনা বুকজলে ভাসছে কামঠের মতো মুখ রেখে জলে! জমিলা চোখ মুছল। কতদূরে একটা ছেলে পড়ে রয়েছে। আছে কী গেছে সেও বা কে জানে! ভুতনির চরের দীর্ঘশ্বাস পড়ল ফুলহারে। ভুতনির স্তনবৃন্ত শুকিয়ে কসকসে কাঠ! বুকের উপর শুধুই বালি।
সন্ধ্যে বড় হলে কুঁচোমাছের ঝালে জবজবে প্যাঁজ আর রসুন।
ফোড়নে খিদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। জিভের লালা ঝোল টেনে নিল ভেতরে রহমতেরা। জলের
ধারে সড়াত সড়াত শব্দ পাটের নৌকার গর্ভ খালাস করছে জোড়া জোড়া হাত। চাষী থেকে দিন মজুর! লরী লরী পাট ছড়িয়ে যাবে
পথ থেকে রাজপথে। মান্দাসের ভেলায় চড়ে বেহুলার বেহালার করুন সুর ভেসে বেড়ায় নদী
শরীর জুড়ে।
খয়রাতি
হাঁ করে ঘুমোচ্ছে ছেঁড়া ফ্যাসা চুল। কষ বেয়ে গড়িয়ে আসছে ভেজা লালা। ভোররাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুম লেগে গেছে চোখে। বড় গাঙ পেরিয়ে আসতে হয়েছে ছেঁড়া ফ্যাসা, খড়খড়ে, রুক্ষ লাল ফিতে চুলেদের। সরকারী খয়রাত এখন বাতাসে উড়ছে, পেড়ে নিলেই হলো। বিভিন্ন খাতে খয়রাতি। জোড়াতালি দিন। ভুখা পেট খয়রাতির গল্প মেখে ভাত খেতে ভালোবাসে। গল্পে মশলা মেখে ছড়িয়ে দিলেই গন্ধ ছড়াবে ঘরে ঘরে।
বছর বিউনির দল সব কোলে কাঁখে নিয়ে হাজির। মরণের ভয়ে কী পেট
ভরে! না দরিয়ার জলে ডুবে! পেটের টান নাড়ির টান
জড়িয়ে পাক দেয় শরীরে বার বার। থুতু ফেলল খড়খড়ে গাল। থুতু ছড়িয়ে গেল চারদিকে। ভোটে
ছাপ্পা দিয়ে দিলে কড়কড়ে কাগজ ওড়ে না,
লাট খেতে থাকে চার দেওয়ালে, ইবলিশের আড্ডায়! ভিড়
দেখেই টমটমাটম লাট্টু ঘোরে বনবন, নেতার হাতে! চেটোয় মাখা খৈনি চুন ডলতে ডলতে খাতায় টিক দেয় টাক মাথা! হাতের
লাট্টু ঘুরছে, সার সার পিঁপড়ের মিছিল
গুড় খুঁজে যাচ্ছে ঘাড় গোঁজ করা চন্দ্রবিন্দু সময়ে। 🚫
শুভশ্রী সাহা |
ইতিহাসে
স্নাতকোত্তর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখালেখি লিটিল ম্যাগাজিনে, গল্প, কবিতা মুক্ত গদ্য
এবং প্রবন্ধ।
প্রথম
গ্রন্থ কবিতা, ( আমি সে ও সখা) যৌথ
একক গ্রন্থ
মুক্তগদ্য, ফেরিঘাটে একা।
সহ সম্পাদক, রায়ান পত্রিকা।
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
2 মন্তব্যসমূহ
মনভেজা লেখা। সহজিয়া ভাষায় একেবারে শিকড় ধরে টান। অপূর্ব।
উত্তরমুছুনশরতের মেঘের মতো। ছেঁড়া ছেঁড়া, মন উদাস করা।
উত্তরমুছুন