সমান্তরালের চক্করে
আবেশ কুমার দাস
What do they know of cricket who only cricket know?
বাইশ গজে যদিও আকছারই ঘটে এমনটা। একশো বছরের
প্রাচীন নজির আচমকাই ছুঁয়ে ফেলেন কেউ কেউ। কিন্তু খোদ ময়দানি ঘটনাপ্রবাহও হাঁটবে
সেই পথেই! নিউ নর্মাল দুনিয়ায় শোনা যাবে বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব ইতিহাসের পদধ্বনি! এতটা
দুরাশা বোধহয় কেউই করেনি। এবং কিমাশ্চর্যম! অতিমারি না এলে কি ঘটত এসবের কিছুই!
ভাবতে অবাক লাগে, কোথায় ফ্র্যাঙ্ক
উলি,
স্টিউয়ি ডেম্পস্টার, জর্জ হেডলিদের পৃথিবী! আর কোথায় উইল রোডস, রোহিত শর্মা, দাসুন শনকার!
কিন্তু পরিণামে কেমন মিলে গেল প্রায় সাড়ে একানব্বই বছরের এপার-ওপারের সেই দুই
বাস্তবতা!
শেষ থেকেই শুরু করা যাক বরং। সময় মতো ফেরা যাবে সূচনায়।
২০২১ মরশুম।
১৮-২৩ জুন। সাউদাম্পটনের রোজ বোল ময়দান। হয়ে গেল
বহু প্রতীক্ষিত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,৪২৫)। প্রতিপক্ষ ছিল কেন উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ড ও বিরাট
কোহলির ভারত।
৪-৮ অগাস্ট। নটিংহ্যামের ট্রেন্ট ব্রিজ ময়দান। বল
গড়াল পাতৌদি ট্রফির (ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত পাঁচদিনের ইন্দো-অ্যাংলো দ্বৈরথ)
উদ্বোধনী টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২,৪২৮)। গায়ে
ব্লেজার চড়িয়ে টস করতে গেলেন দুই প্রতিপক্ষ অধিনায়ক জো রুট ও বিরাট কোহলি।
বিরাট কোহলি ও জো রুট |
ঘটনাচক্রে ১৮-২৯ জুলাই সীমিত ওভারের সংক্ষিপ্ত
শ্রীলঙ্কা সফর ছিল ভারতের। বিসিসিআই-এর দিক থেকে না হলেও অতিমারি পর্বে আর্থিক
ভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের পক্ষে এই সিরিজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তিনটি
একদিনের আন্তর্জাতিক ও তিনটি কুড়ি-বিশ আন্তর্জাতিকের দৌলতে অক্সিজেন স্যাচুরেশন
লেভেল কিছুটা বাড়ার আশা ছিল দ্বীপরাষ্ট্রের ক্রিকেটব্যবস্থায়। কিন্তু বিরাট কোহলিরা
যে তখন বিলেতে। শিখর ধাওয়ানের অধিনায়কত্বে তুলনামূলক ভাবে দ্বিতীয় সারির আর-একটি
দলকে পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কায়। এবং ২০ জুলাই দ্বিতীয় একদিনের খেলায় (দিনরাতের) দাসুন
শনকাদের মহড়া ঠিক যখন নিচ্ছে শিখর ধাওয়ানের ভারত, পৃথিবীর আর-এক প্রান্তে রোহিত শর্মাদের নেমে পড়তে হল উইল রোডসের অধীনস্থ
নির্বাচিত কাউন্টি একাদশের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণির খেলায়। দুই ভিন্ন ভিন্ন
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুই সমান্তরাল ক্রিকেট গোলার্ধে কোনও দেশের এভাবে জোড়া একাদশ
নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা চরিত্রে অতিবিরল।
শিখর ধাওয়ান |
রোহিত শর্মা |
অতএব, দুই ক্রিকেট গোলার্ধে দুই সমান্তরাল একাদশ নামিয়ে দেওয়া।
এবং একানব্বই বছর পাঁচ মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই
ইতিহাসের ‘প্রায়’ পুনরাবর্তন।
কিন্তু ঠিক কী ঘটেছিল সেই বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব
জমানায়?
ফেরা যাক সেই সূচনায়।
সময়টা বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক। টেস্ট ক্রিকেট
তখনও ইংরেজ, অস্ট্রেলীয় ও প্রোটিয়াদের মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকলেও সামাজিক ভাবে খেলাটা কিন্তু ছড়িয়েছিল বহু দেশেই। ক্রস ইয়ারের
(অক্টোবর থেকে মার্চ) অ্যাশেজ শেষে নিউজিল্যান্ডে কিছু ট্যুরম্যাচ খেলে ফিরতেন
ইংরেজরা। বেসরকারি টেস্ট (প্রথম শ্রেণির খেলার স্বীকৃতি থাকে যাদের) খেলতে
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ভারতবর্ষ বা সিংহলে
সফর চলত মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের। আফ্রিকায় খেলাটা ছড়িয়েছিল রোডেসিয়ায় (অধুনা
জিম্বাবোয়ে)। এমনকি ১৯২৯-৩০ মরশুমের শেষপর্বে স্যার জুলিয়েন কানের একাদশ গিয়েছিল
সংক্ষিপ্ত আর্জেন্টিনা সফরেও!
ইতিহাসের এই পর্বেই কলোনিগুলির মধ্যে টেস্ট
ক্রিকেটকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মে, ১৯২৬-এর এক সভায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডকে টেস্ট-কৌলীন্য দেওয়া হয়
ইমপেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্সের (অধুনা নিয়ামক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট
কাউন্সিলের সাবেক রূপ) তরফে। এবং অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ইতিমধ্যেই
নির্ধারিত খেলাগুলির সূচি বাঁচিয়ে তোড়জোড় চলতে থাকে দুই নবীন টেস্ট-কুলীন দেশে
ইংরেজদের পূর্ণাঙ্গ সফরের।
দেখে নেওয়া যাক পরবর্তী মরশুমগুলিতে ঘরোয়া
কাউন্টির বাইরে কখন কোথায় ব্যস্ত ছিলেন ইংরেজরা।
১৯২৬ মরশুম। বিলেতের মাটিতে পাঁচ টেস্টের
অ্যাশেজ।
১৯২৬-২৭ মরশুম। বেসরকারি টেস্ট খেলতে যথাক্রমে
সিংহল ও ভারতবর্ষ এবং জামাইকা সফরে যায় আর্থার গিলিগান এবং লিয়োনেল টেনিসনের
অধীনস্থ দু’টি দল।
১৯২৭ মরশুম। নিউজিল্যান্ডের ইংল্যান্ড সফর। যদিও
কোনও খেলাই পায়নি সরকারি টেস্টম্যাচের স্বীকৃতি।
১৯২৭-২৮ মরশুম। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজদের পাঁচ
টেস্টের পূর্ণাঙ্গ সফর।
১৯২৮ মরশুম। তিন টেস্টের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড
সফরে আসে কার্ল নুনেসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। খোদ লর্ডসেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে
আবির্ভাব ঘটে ক্যারিবিয়ানদের। যদিও প্রীতিকর হয়নি শুরুটা। পার্সি চ্যাপম্যানের
ইংল্যান্ড ইনিংস ও ৫৮ রানে জিতে নেয় টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৭৩)। অভিষেক ঘটে
পরবর্তীতে বডিলাইন ব্লু-প্রিন্টের জনক হিসেবে কুখ্যাত ডগলাস জারডিনের।
১৯২৮-২৯ মরশুম। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পাঁচ টেস্টের
অ্যাশেজ।
১৯২৯ মরশুম। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পাঁচ
টেস্টের ঘরোয়া সিরিজ।
একটা কথা এখানে বলা দরকার। যে সময়পর্বের কথা
হচ্ছে তখনও ইতিহাসের সেই পর্বটা দিব্যি চলছে যখনকার অনেক খেলাই আসলে পরবর্তীতে
পেয়েছিল সরকারি টেস্টম্যাচের স্বীকৃতি। বহুদিন অবধি ইমপেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স
ঠিকঠাক সংজ্ঞাই নির্ধারণ করতে পারেনি টেস্টম্যাচের। স্বীকৃতিদানের কাজটাও চলত
অনেকটাই মর্জিমাফিক। নামেই শুধু নয়, তৎকালীন আইসিসি-র কাজেকর্মেও যেন ছিল ইমপেরিয়ালিজমের ছোঁয়া। বলা মুশকিল কেন
নিউজিল্যান্ডের ১৯২৭ সফরের কোনও খেলাকেই দেওয়া হয়নি সরকারি টেস্টম্যাচের স্বীকৃতি।
১৯২৯-৩০ মরশুম। ঠাসা সূচির ফাঁকে এই একটা সময়
ছিল। উপরন্তু ক্রস ইয়ার মরশুম। শীতপ্রধান বিলেতে কোনও কোনও জায়গায় পারদ নেমে আসে
হিমাঙ্কের কাছাকাছি। ক্রিকেটের ঘোরতর অনুপযোগী সেই আবহাওয়ায় কাউন্টির কোনও খেলাও
থাকে না। দুই নবীন টেস্ট-কুলীন দেশে তড়িঘড়ি দু’টি
সমান্তরাল সফরের সিদ্ধান্ত নেয় মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব। নিউজিল্যান্ডের
ক্রাইস্টচার্চ (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৮৬) ও বার্বাডোজের জর্জটাউন (টেস্ট ক্রমাঙ্ক:
১৮৭) নির্বাচিত হয় দুই সফরের যথাক্রমে দুই প্রথম টেস্টের অকুস্থল হিসেবে। সমস্যা
বাধে দলগঠনে। নামি খেলোয়াড়দের কেউই আগ্রহ দেখাননি সফর দু’টিতে। মাথায় রাখতে হবে, ক্রিকেট প্রশাসনের কাঠামো তখনও অপেশাদার। ক্রিকেটাররা বেঁকে বসলে জোরাজুরির
বিশেষ উপায় থাকত না নির্বাচকদের। বাধ্য হয়েই দলনেতার ভূমিকায় বেছে নিতে হয় দু’টি নতুন মুখকে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জন্য অনারেবল
ফ্রেডি ক্যালথর্প। এবং কিউয়ি সফরের জন্য হ্যারল্ড গিলিগান। তবে সাবেক সফরগুলির
অভিজ্ঞতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজে তুলনামূলক অভিজ্ঞ দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
ফ্রেডি ক্যালথর্প |
হ্যারল্ড গিলিগান |
স্টিউয়ি ডেম্পস্টার, কিউয়ি ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম যুগের ব্যক্তিত্ব |
জর্জ হেডলি, আদিপর্বের বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার |
তা ক্যালথর্পের সঙ্গে যাঁদের পাঠানো হয় ‘অভিজ্ঞতা’-য় সত্যিই খামতি ছিল
না তাঁদের। ছিলেন বিয়াল্লিশের নাইজেল হেগ। একচল্লিশ ছুঁইছুঁই প্যাটসি হেনড্রেন।
উনচল্লিশের অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম (যিনি এই সফরেই টেস্ট ইতিহাসের বরিষ্ঠতম ট্রিপল
সেঞ্চুরিয়ন হয়ে নজির গড়েন)। ধরাধামে অর্ধশতাব্দী পার করে দেওয়া জর্জ গান। এঁদের
মাথার উপর ছিলেন তখনও আটত্রিশ না-ছোঁয়া ‘যুবক’ ক্যালথর্প। তবে চমকের শেষ এখানেই নয়। ন্যাটা অর্থোডক্স
হিসেবে জাহাজের টিকিট পান উইলফ্রেড রোডস। যাঁর টেস্ট অভিষেক সেই বিগত শতকে। ১৮৯৯
মরশুমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নটিংহ্যাম টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬০)। যেখানে
খেলেছিলেন খোদ ডব্লু জি গ্রেস। ঘটনাচক্রে কিংস্টনে জীবনের শেষ টেস্ট (টেস্ট
ক্রমাঙ্ক: ১৯৩) যেদিন খেলতে নামলেন রোডস তখন তাঁর বয়স পার করেছে বাহান্নর দাগ।
প্রসঙ্গত, উক্ত টেস্টের প্রথম দিন (৩ এপ্রিল, ১৯৩০) মাঠে নামা এগারো ইংরেজের বয়সের গড় ছিল ‘মোটে’ ৩৭ বছর ১৮৮ দিন
(দলে ছিলেন বছর কুড়ির বিল ভোস)। বলাই বাহুল্য শেষ দু’টি তথ্যই আজও বিচূর্ণ না-হওয়া দুই উজ্জ্বল বিশ্বনজির। এবং
নজিরগুলির ভবিষ্যতে চুরমার হওয়ার সম্ভাবনাও আপাতত পাঠকের কল্পনাশক্তির উপরই ছেড়ে
দেওয়া যায়।
তুলনায় হ্যারল্ড গিলিগানের দলে অভিজ্ঞ বলতে ছিলেন
তেতাল্লিশ ছুঁইছুঁই ফ্র্যাঙ্ক উলি। প্রসঙ্গত, আর্থার গিলিগান উৎসাহ না দেখানোয় অধিনায়কত্বের সুযোগ আসে তাঁর কনিষ্ঠ সহোদরের
সামনে। হ্যারল্ডের বয়সও অবিশ্যি ততদিনে পার করেছে তেত্রিশের দাগ। তা
ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে একদফায় অভিষেক ঘটে সতেরো জনের। গোটা কিউয়ি
একাদশের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটের আসরে পদার্পণ ঘটে মরিস অ্যালম
(পরপর তিন বলে বিপক্ষ অধিনায়ক টম লরি, উইকেটরক্ষক কেন জেমস ও পেসার ফ্রেডরিক ব্যাডকককে ফেরত পাঠিয়ে নজিরও গড়ে ফেলেন
রীতিমতো),
মরিস টার্নবুল, স্ট্যান ওয়ার্দিংটন, স্ট্যান নিকোলস, টিক কর্নফোর্ড (ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করা সর্বকালের
খর্বতম উইকেটরক্ষক) ও স্বয়ং হ্যারল্ড গিলিগানের।
আগেই বলা হয়েছে দুই সমান্তরাল সফরের যথাক্রমে দুই
প্রথম টেস্টের অকুস্থল নির্ধারিত ছিল ব্রিজটাউন ও ক্রাইস্টচার্চে। আকাশপথে দুই
শহরের দূরত্ব চোদ্দো হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি। ভূগোলকের গায়ে ব্রিজটাউনের
ঠিকানা ১৩০৫’৫৯’’ উত্তর-৫৯০৩৭’ পশ্চিমে। আর
ক্রাইস্টচার্চের ৪৩০৩১’৫৯’’ দক্ষিণ-১৭২০৩৭’৫৯’’ পূর্বে। সেই হিসেবে ব্রিজটাউনের স্থানীয় সময় ষোলো ঘণ্টা
পিছনে চলে ক্রাইস্টচার্চের। উপরন্তু দুই মহাদেশের মধ্যবর্তী প্রশান্ত মহাসাগরের
দুস্তর জলধারা চিরেই চলাচল আন্তর্জাতিক তারিখরেখার। এসব মিলেমিশে ব্রিজটাউনে যখন
সোমবার বিকেল পাঁচটা ক্রাইস্টচার্চে তখন মঙ্গলবার সকাল ন’টা। ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট চলার কথা ছিল ১০-১৩ জানুয়ারি। আর
ব্রিজটাউন টেস্টের ধার্য সময়সীমা ছিল ১১-১৬ জানুয়ারি। সময়ের ব্যবধান মাথায় রাখলে
ব্রিজটাউনে যখন টস করতে যাচ্ছেন টেডি হোড-ফ্রেডি ক্যালথর্প, ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের প্রথম দুটো দিন (যদিও দ্বিতীয় দিনের
পুরোটাই ধুয়ে যায় বৃষ্টিতে) উতরে দিয়ে ফ্র্যাঙ্ক উলিরা তখন হোটেলের ঘরে মগ্ন
পানাহারে। ১২ জানুয়ারি, রবিবার দিনটা দুই
টেস্টেই ছিল বিশ্রাম। আবার ১৩ জানুয়ারি টম লরির দলবলকে ৮ উইকেটে পরাস্ত করে যখন
মাঠ ছাড়ছেন হ্যারল্ড গিলিগানরা, সবে হয়তো তখন
বিছানায় যাবেন উইলফ্রেড রোডস।
উইলফ্রেড রোডস, টেস্ট ক্রিকেটের বরিষ্ঠতম ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে আজও স্মরণীয় |
কিস্সার আসল শুরুয়াত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হওয়ার কথা ছিল আরও দু’টি টেস্ট। যার শেষটি নির্ধারিত ছিল ১৪-১৭ ফেব্রুয়ারি অকল্যান্ডে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৯০)। পক্ষান্তরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চার টেস্টের সিরিজের তৃতীয়টির দিনক্ষণ ধার্য ছিল ২১-২৬ ফেব্রুয়ারি জর্জটাউনে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৯২)। অতঃপর? কিস্সা অকল্যান্ড কা। বৃষ্টিবিঘ্নিত টেস্টম্যাচে প্রথম দু’দিনের (১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি) খেলাই যায় ভেস্তে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ছিল রবিবার, বিশ্রাম। খেলা হয় শুধু শেষ দিন, ১৭ ফেব্রুয়ারি। ৮৮ ওভারে ইংল্যান্ডের ৩৩০/৪ ডিক্লেয়ারের (শতরান করেন টেড বাউলি ও কুমার শ্রী দলীপসিংজি) জবাবে অবশিষ্ট ৩৪ ওভারে জ্যাকি মিলসের উইকেটটি খুইয়ে কিউয়িরা তোলে ৯৬। আবহাওয়ার মারে বঞ্চিত দর্শকদের কথা ভেবে আর-একটি অতিরিক্ত টেস্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয় অকল্যান্ডে। সিরিজ হয়ে যায় চার টেস্টের। পরবর্তী অকল্যান্ড টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৯১) সময়সীমা ধার্য হয় ২১-২৪ ফেব্রুয়ারি।
পাঠক টের পাচ্ছেন কী ঘটতে চলেছে এরপর! বলে রাখি
গায়না ও নিউজিল্যান্ডের দুই শহরের অবস্থান। ভূগোলকের গায়ে জর্জটাউনকে খুঁজে পাওয়া
যায় ৬০৪৮’১৬’’ উত্তর-৫৮০৯’১৮’’ পশ্চিমে। আর
অকল্যান্ডকে ৩৬০৫২’ দক্ষিণ-১৭৪০৪৬’ পূর্বে। উপরন্তু ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে গায়নার শহরটিতে
সূর্যাস্ত হয় সন্ধ্যা ছ’টার পর। দুয়ে মিলে
যখন অকল্যান্ডে শুরু হবে খেলা, জর্জটাউনে তখনও
চলবে টেস্টের শেষ সেশন! সবটাই সময়ের নিখুঁত ফারাক আর আবহাওয়ার মারে বিগত অকল্যান্ড
টেস্ট বিঘ্নিত হওয়ার পরিণাম। সফরের প্রাক্কালেও কিন্তু ধার্য ছিল না এমনতর সূচি।
ধন্য প্রকৃতির খেয়াল!
যদিও অল্পক্ষণের জন্যই ঘটেছিল ঘটনাটা। উপরন্তু
অকল্যান্ড টেস্ট দ্বিতীয় দিনে গড়ানোর আগে তো ঘটা সম্ভবই ছিল না অত্যাশ্চর্য কিছুই।
কেন?
দেখে নেওয়া যাক সেই বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব পৃথিবীর দুই প্রান্তে
ঠিক কী কী ঘটছিল পরপর ক’দিন।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল। অকল্যান্ড। শুরু হল প্রথম
দিনের খেলা। জর্জটাউনে তখনও অস্ত যায়নি ২০ ফেব্রুয়ারির সূর্য।
বর্তমান ইডেন পার্ক, অকল্যান্ড, সমান্তরাল দুই টেস্টের প্রথমটির পটভূমি |
২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল। অকল্যান্ড। দিনটা রবিবার।
বিশ্রাম। জর্জটাউনে চলছে দ্বিতীয় দিনের অন্তিম সেশন।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল। অকল্যান্ড। যত তাড়াতাড়ি হয়
নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে (১৭৪/৪-এ বেল পড়েছিল শনিবারের খেলায়) যতি টানতে নামলেন
ইংরেজরা। জর্জটাউনে তখনও রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি।
দিনটা বিশ্রামের।
আজকের বোর্দা ক্রিকেট ময়দান, জর্জটাউন, সমান্তরাল দুই টেস্টের দ্বিতীয়টির পটভূমি |
একশো চুয়াল্লিশ বছরের দীর্ঘ টেস্ট ইতিহাসে ওই একবারই ঘটেছিল ঘটনাটা। আন্তর্জাতিক তারিখরেখার পূর্ব ও পশ্চিমের সেই দুই শহরে তারিখ দুটো ছিল যথাক্রমে ২২ ও ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০। ঘটনাটার স্থায়িত্ব ছিল মাত্রই ঘণ্টাখানেকের।
যেটা বলার, মানুষ কিন্তু জেনেশুনে বানায়নি সেই সূচি। ভেবেচিন্তে ইতিহাস রচনার ক্ষমতাই থাকে না মানুষের হাতে। অতিমারি না এলে যেমন ভাবতই না বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া— বিলেত ও শ্রীলঙ্কায় একই দিনে যথাক্রমে প্রথম শ্রেণির ট্যুরম্যাচ ও পঞ্চাশ ওভারের দিনরাতের আন্তর্জাতিকে জোড়া ভারতীয় একাদশ মাঠে নামিয়ে দেওয়ার কথা। দ্বিতীয় দফায় ঘটনাটা যদিও ঘটেনি টেস্ট ক্রিকেটের আসরে। তাতে কী! দু’বারই ঘটনাপ্রবাহের নেপথ্যে থেকে গিয়েছিল মানুষের নিয়ন্ত্রণের অতীত কিছু অনুষঙ্গ। মানুষ নয়, প্রকৃতিই আসলে ইতিহাসের নিয়ন্তা— দুই ভিন্ন যুগের পৃথিবীতে দু’ভাবে সেই ইঙ্গিতটুকুই কি বয়ে এনেছিল ময়দানি ঘটনাপ্রবাহ! 🚫জন্ম ৩০ মার্চ, ১৯৮৩ নৈহাটিতে। প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। যদিও অনুরাগ সাহিত্যে। গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। এখনও অবধি প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি। তিনটি ছোটগল্প সংকলন --
বনলতার বিজন (২০০৯),
পুরনো দিনের ছবি (২০১২)
মর্ফিয়ুস (২০১৫)
যথাক্রমে সিনেমা ও ক্রিকেট বিষয়ক দু'টি প্রবন্ধের বই --
তপন সিংহঃ সার্বিক চলচ্চিত্র বীক্ষা (২০১৬)
বাইশ গজের কিসসা (২০১৯)
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
1 মন্তব্যসমূহ
ক্রিকেটের ইতিহাস মিয়ে যারা চর্চা করেন, খেলাপ্রেমী পাঠক কিংবা ক্রিকেট ঐতিহাসিক সকলের কাছেই এই বিশেষ প্রবন্ধটি সন্দেহাতীত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয় নির্বাচনটিও একেবারেই অভিনব। এই অভিনবত্ব এবং লেখকের দক্ষ, প্রজ্ঞাশীল কলম এই বিশেষ রচনাটিকে দিয়েছে অন্য এক ক্রিকেটিও রঙ। এমন একটি তথ্যপূর্ণ লেখা উপহার দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। সম্পাদকদ্বয়কে বিশেষ ধন্যবাদ জনাব এমন বিষয়কে পত্রিকার পাঠ্যসূচিতে বেছে নেবার জন্য। সম্পাদকদ্বয়ের কাছে আর্জি– আগামীতে এমন সমৃদ্ধশালী তথ্য মূলক লেখা আরও পড়তে চাই।
উত্তরমুছুন