ছবি - কৃষ্ণধন আচার্য
 

সংসারে প্রতিদিন আমরা যে সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলিয়া থাকি উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখণ্ড সত্যকে স্বীকার করিবার দিনএইজন্য উৎসবের মধ্যে মিলন চাই। একলার উৎসব হইলে চলে না। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/উৎসব)


উৎসব একলার নয়, উৎসব মিলনের। কার সঙ্গে? নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে? বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে? চেনা পরিচিতদের সঙ্গে? উত্তর সবকটি ক্ষেত্রেই ‘হ্যাঁ’। অর্থাৎ আমাদের মিলনের প্রতিটি ক্ষেত্র কিন্তু কোনো না কোনো গন্ডীবদ্ধ। গন্ডীবদ্ধ মিলন। আরো বিপদ, অনেকক্ষেত্রে উৎসব-মিলনের মাঝে স্বার্থসিদ্ধির অনুপানও রেখে দিই আমরা। কোন যে অখন্ড সত্যের কথা বলে গেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আমরা বোধহয় এখন তা টের পাই না। যে কোনো সামাজিক সংস্পর্শ আমরা আমাদের তুলাদন্ডে মাপতে শুরু করে দিই। উদ্দেশ্য একটাই, লেনদেনের মাঝে আমার দিকে অন্তত একটু বেশি তুলাদন্ড হেলে থাকে।

       সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা। লেখকের ফোন আসলে সম্পাদক ডিসপ্লেতে ফুটে ওঠা নাম দেখে স্ট্র্যাটেজি ভাঁজতে শুরু করেন, সম্পাদকের ফোন আসলে লেখক তাই করেন। লেখক, লেখককে ফোন করলেও কথার খেলা চলে। কার পেট থেকে কে কতটা খবর বার করে আনতে পারল। লেখালেখি জগতের মিলনের যে উৎসব বইমেলায়, পূজাসংখ্যায় পালিত হয় তার মাঝে 'অখন্ড সত্য' অনাকাঙ্খিত এবং অনাবিষ্কৃতও বটে।

       চারপাশে তাকালে অবাক হয়ে যেতে হয়। যার নামী পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হল না তার আনন্দ নেই, যার নামী পত্রিকায় অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে তারও আনন্দ নেই কারণ এবারে তার লেখা কোথাও কোথাও বাদ পড়েছে। অনেকে আবার এক ডজন পুজো সংখ্যায় লিখেও ডিপ্রেশনে থাকেন, যথেষ্ট লেখা হয়নি বলে। ছোটোবেলায় শোনা উপদেশ 'সব প্রশ্নের জবাব লিখে আসবে, ভুল হলেও' অনেকেই বড়বেলায় কাজে লাগান নিষ্ঠা সহকারে, সব পত্রিকায় লিখতেই হবে। এর ওপর পত্রিকার মালিকানা বদলালে লেখক তালিকা পাল্টে যায়, পাল্টে যায় ক্ষমতার অলিন্দে বদল হলেও এমনকি ফোন ধরার লোক বদল হলেও। চেপে দেওয়া আর তুলে ধরার ঢেঁকিদারদের কথাও শোনা যায়। সাহিত্যের অলিন্দ না 'অলিন্দ যুদ্ধ' বোঝা দায়। শত ধারা উপধারায় বিভক্ত ব-দ্বীপ অঞ্চল। তবুও আশার কথা এখনো তা ফলনশীল, সর্বক্ষেত্রে বন্টনধন্য না হলেও।

    নতুন যারা লিখতে এসেছে তাদের প্রাণেও আনন্দ নেই। সর্বক্ষণ কোথায় লেখা গোঁজা যায় সেই যোগাযোগেই দিন চলে যায়। দিন চলে যায় হিসাব করতে ক-এর কাছে গেলে খ-এর সঙ্গে চ্যানেল হতে পারে। খ-এর সঙ্গে কিছুদিন কাটালে গ-এর সঙ্গে আলাপ হবেই। গ-এর সঙ্গে আলাপ হলে…. আর এইভাবেই নবীন লেখকের ঘর জুড়ে তৈরি হতে থাকে ব্লু-প্রিন্ট। তারা শিখে যায় ধাঁচের গল্প লেখার কৃৎকৌশল। যে পত্রিকায় যে ধাঁচের গল্প যাবে বলে মহাজনরা পথ প্রদর্শন করেছেন, সেই পত্রিকার জন্য সেই ধাঁচের গল্পই গড়ে ওঠে। এমনও দেখা যায় উঠতি লেখকের লেখার মধ্যে আলাদা আলাদা শৈলী। শক্তিশালী লেখক ভেবে আনন্দ পাবার কিছু নেই, যে গুরু যখন যেমন সংশোধন করে দিয়েছেন, শৈলী সেই পথে বয়ে গেছে। নিজের পথে তার আর হাঁটা হয়নি। গড়ে ওঠেনি নিজস্ব কন্ঠস্বর। 

       বইচর্চা, গল্প-চর্চার গ্রুপগুলিরও তথৈবচ অবস্থা। কে যে কার ল্যাজে পা দেবার জন্য বসে আছে তা কে জানে। খাপ পঞ্চায়েত শুনেছি, ভার্চুয়াল খাপ পঞ্চায়েতের দেখাও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। শ্রুয়েডিংগারের বেড়ালদেরও দেখা যায় যারা একইসঙ্গে একধিক অন-লাইন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কোয়ান্টাম মেকানিকস্‌ আয়ত্ত্ব করে ফেলেছেন। বাস্তব সংগঠনের অভিজ্ঞতাবিহীন ভার্চুয়াল সংগঠকদেরও উদ্ভব ঘটছে। বিবর্তনে তা কী দাঁড়াবে কেউ জানে না। এদিকে বাসি সন্দেশকে নেড়ে নেড়ে মন্তব্যের চকলেটে ভিজিয়ে তাকে চকলেট সন্দেশ বানিয়ে দেওয়ার ময়রাদের কদর উর্দ্ধগামী। এইসবের মাঝে সহিতের ভাব, মিলন কোথায় যে পাবে নবীন প্রজন্ম তা তারাই জানে। পৃথিবীটা ছোটো হতে হতে আর বোকা বাক্স নয়, হাতের তালুর মধ্যে মোবাইলে বন্দী। প্রচার এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন নিয়ন্ত্রক। নবীন প্রজন্মের লেখকেরা সেই মাঠে শক্ত খেলা খেলছে। অন্তঃকরণ থেকে তাদের জয় দেখতে চাই। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এগিয়ে দেওয়া টোপ উপেক্ষা করে অচেনাকে চিনে নেবার সনাক্ত-শক্তি তাদের আছে। 

       তবুও উৎসব। উৎসব ঘিরে লেখার উৎসব। তা আমাদের গর্বের। অরণ্যের শোভা শুধু বৃক্ষে হয় না। একইভাবে এই লেখার উৎসবকে ঘিরে আমরা কত নতুন কলমের সন্ধান পাই। কত নতুন বৃক্ষের মাথা চাড়া দেওয়া আমরা দেখতে পাই। কত নয়নাভিরাম গুল্ম, লতা-পাতা নীরবে মেলে ধরে নিজেদের এই অক্ষর অরণ্যে। মুছে যেতে যেতে কোনো কলম আবার ঝলসে ওঠে। আবার চিরকালের কলমদের থেকে কখনো জং পড়ে অক্ষরে জড়িয়ে যাবার চিহ্ন দেখা যায়। এই অক্ষর অরণ্য আমাদের সম্পদ।

    তবুও আমরা ধরে নিই পদার্থবিদ্যার যত ধ্রুবকের মতো, কোথাও ধ্রুব পাঠকেরা এখনো আছেন। তারা ঠিকই পড়বেন, লেখা মনে ধরলে লেখককে মনে রাখবেন। পত্রিকা মনে ধরলে পত্রিকাকে মনে রাখবেন। মনে রাখবেন সাহিত্যজগতের সমবেত এই প্রচেষ্টাকে। কোভিড দেখিয়ে দিয়েছে নিজের নিজের করে, স্কোয়ার ফিটের যে স্বর্গ আমরা গড়ে তুলছিলাম তা কত ঠুনকো। উল্টে যাদের সেই স্বর্গ নেই তারা কিন্তু ঠিকই হাতে হাত ধরে লড়ে গেছে, হাত ছাড়েনি। অজস্র মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নানা ভাবে। আমরা দেখেছি আমরা পারি, এখনো পারি। এখনো আমরা কিন্তু মিলিত হতে পারি। শুধু হাতটা একটু বাড়ানো দরকার। হাত ধরার আনন্দটা কিন্তু ঠিক আগের মতোই আছে। পাল্টায়নি একটুকুও। 

    দুই দশক পার করে দিয়ে এই প্রথম সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার উৎসব সংখ্যা। যা যা ভালো লাগবে, যা যা ভালো লাগবে না তা লেখকদের লেখার তলায় মন্তব্য করে দিলে অরণ্যের গাছগুলো অবহেলার দাবানল থেকে রক্ষা পায়। ঠিকঠাক অক্সিজেনের ভারসাম্যটা রক্ষা করতে পারে। 

    সবাইকে সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার পক্ষ থেকে উৎসবের শুভেচ্ছা রইল। শুভেচ্ছা রইল, শুধু সাইন্যাপস্‌ নয় আরো অজস্র মুদ্রিত বা অন-লাইন পত্রিকা থেকে ভালো ভালো লেখা আবিষ্কার করার। এভাবেই হয়ত 'মিলনের উৎসব' আর কোনো 'অখন্ড সত্য' সত্যি হয়ে উঠবে। 🚫



অ থ বা

নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার) 
ক্লিক করে সেই লেখা পড়তে পারেন  

 
 
 








 
 
 
 
 
 

 
আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏