ব্যবহৃত ছবি - কৃষ্ণধন আচার্য |
তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও পিঙ্গচক্ষু
চিরঞ্জয় চক্রবর্তী
জয়নারায়ণ এখন আর ওকালতি করেন না। বয়স হয়েছে। চার ছেলে পাঁচ নাতি নাতনি নিয়ে দিব্য আছেন। সারাদিন পুজো-আচ্চা,বইপত্র নিয়ে কেটে যায়। সন্ধ্যের পর পড়াশুনা করতে একটু অসুবিধা হয়। মনে হয় শব্দগুলো অস্পষ্ট, কখনও কখনও শব্দগুলো পেন্ডুলামের মত দোলে। মনটা খারাপ হয়। কয়েকদিন বিকেলে পাশের পার্কে গেছিলেন। পাড়ার লোকেরাই আড্ডা মারে। বয়স্ক লোকদের সঙ্গে বসেছিলেন। অনেকের মুখ চিনতেন, নাম জানতেন না। জানলেন, অনেক কথা হল। কয়েকদিন যাওয়ার পর মনে হল, তিনি আড্ডায় প্রবেশ করতে পারছেন না। সবাই সংসারের কথা বলে। অথবা রাজনীতির কথা বলে। সব কিছু নিয়ে সবার দুঃখ আছে। হতাশা আছে। মনে হয় সবাই যেন পার্কের মাঝখানে এসে বাতাসে দুঃখ ছেড়ে দেয়। যেন বলে, “যা দুঃখ, যা যা”।
একদিন সন্ধ্যেবেলা তিনি চুপচাপ বসেছিলেন,
পার্কের বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করল, আপনি ইদানিং
আসেন কিন্ত কথা বলেন না কেন?
আপনাদের বিষয়গুলো পছন্দ হয় না। আসি বসি এই
আর কি!
আপনি কিছু বলুন আমরা শুনি।
আচ্ছা। বলে মনে মনে ভাবলেন,
দাদু মুরারীমোহন ঢাকা কোর্টে প্রাকটিস করতেন। সন্ধ্যের পর তিনি কোনও
কাজ করতেন না। প্রায়ই বলতেন, সারাদিন চোর-ডাকাত-পুলিস নিয়ে
কাজ করি, সূর্য ডুবলে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে থাকব, চোর পুলিস বা মক্কেলদের সঙ্গে কোনও কথা নয়। তিনি নাতি-নাতনিদের রামায়ণের
গল্প বলতেন। শিশু জয়নারায়ণও সেই দলের একজন। রামায়ণ
বলতে বলতে একদিন মুরারীমোহনের মনে হয়, রোজ যা বলি, তাই যদি লিখে রাখি, তাহলে রামায়ণ লেখা হয়ে যায়। তিনি
মুখে মুখে রামায়ণের গল্প বলতে বলতে একটা আস্ত রামায়ণ লিখে ফেলেছিলেন। সেটা বই
হয়েছিল। সেই রামায়ণটাইতো বাড়িতে সবাই পড়ে। হাতেখড়ির সময়ে দেওয়া হয়। ঢাকার কালিকা
প্রেসে ছাপা একটা বই এখনও আছে। প্রতিবছর সরস্বতী ঠাকুরের পাশে আর বাড়ির শিশুদের
বিদ্যারম্ভের সময়ে বইটি চাই।
কিছু বলার প্রস্তাব পেয়ে জয়নারায়ণ বিলম্ব
করেন নি। তাই রামায়ণ মহাভারতের গল্প না বলে নতুন গল্প বললেন। গল্পটা তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও পিঙ্গচক্ষুর
গল্প; গোমতী নদির তীরে তীক্ষ্ণবুদ্ধি নামে এক শৃগাল বাস করত। পশুরা তাকে পণ্ডিত বলেই জানত। সবাই সমীহ করত। নদীতে বাস করত পিঙ্গচক্ষু নামে এক
কুমীর ও তার পরিবার। রোজ সকালে জলের থেকে মুখটা তুলে পিঙ্গচক্ষু দেখত তীক্ষ্ণবুদ্ধি জঙ্গলের পশুদের পড়াচ্ছে। তার নিজের খুব
ইচ্ছা হয় পড়াশুনা করতে। একদিন তীক্ষ্ণবুদ্ধিকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিল,
পণ্ডিতমশাই আমাকে পড়াবেন?
তীক্ষ্ণবুদ্ধি হেসে ফেলেছিল,
তুই কী পড়বি! বুড়োভাম। বরং তোর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পাঠাস পড়তে।
পিঙ্গচক্ষু ভাবল, ঠিকইতো, আমার বয়স হয়েছে, লেখাপড়া শিখে আর কী হবে? তার থেকে ছেলেমেয়েদের শেখালে, ওদের ভাবিষ্যত উজ্জ্বল
হবে।
ঘরে ফিরে বউ-এর সঙ্গে আলোচনা করল। ছেলেরা
পড়বে শুনে বউ এর কী আনন্দ, আনন্দ চাপতে না পেরে সে
জলের মধ্যেই একবার নেচে নিল। তার লেজের ঝাপটায় জলও নেচে উঠল। জলের
অন্যান্য পশুরা অবাক পিঙ্গচক্ষুর
বউ নাচছে কেন? বউ বলল, ছেলেদের
পাঠশালায় দেব, ওরা লেখাপড়া শিখবে। তাই আনন্দ হয়েছে। সেই
আনন্দে নাচছি। ছোট ছেলেগুলো কোথায় গেছে, তাদের ডেকে ডেকে ঘরে আনল।
তারপর বোঝাল, দিনকাল খুব খারাপ আসছে, পড়াশুনা
না শিখলে আর উপায় নেই। তোমাদের আমি তীক্ষ্ণবুদ্ধি পণ্ডিতমশাইএর পাঠশালায় ভর্তি করে
দেব, তোমরা লেখাপড়া শিখবে।
পিঙ্গচক্ষুর সাতছেলে। সাতজনেই পড়তে চায়।
স্বামী-স্ত্রী আপত্তি করল না। স্থির হল পরদিন সাত ছেলেকে নিয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধি
পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হবে। পিঙ্গচক্ষুর বউ আনন্দে আত্মহারা। সবাইকে
বলে চলেছে, কাল থেকে আমার ছেলেরা পাঠশালে যাবে।
অনেক অনেক পড়বে। তারপর তীক্ষ্ণবুদ্ধি পণ্ডিতমশাইয়ের মত পাঠশালা খুলবে। জলের
প্রাণীরা তো অবাক, কেউ কোনওদিন শোনেনি জলের প্রাণী লেখাপড়া
শিখেছে। জলের প্রাণী লেখাপড়া শিখে কী করবে?
আমার ছেলেরা পণ্ডিত হবে।
* * *
পরদিন সকালে স্নান করে সাতছেলে নিয়ে
পিঙ্গচক্ষু আর তার বউ পাঠশালায় এসে হাজির। পণ্ডিত ঘর থেকে বাইরে আসতে সাহস পেল না।
পিঙ্গচক্ষু আর বউ যদি কামড়ে ধরে। তাই জানালা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
কী ব্যাপার, সকাল সকাল এলে যে।
ছেলেদের নিয়ে এলাম আপনার পাঠশালে ভর্তি
করতে।
পণ্ডিত বলল,তা
বেশ করেছ। ছোটলোকেরা লেখাপড়া করবে, তোমাদের যেমন মঙ্গল, তাতে দেশেরও শুভ হবে। ওদের তো বিদ্যারম্ভ হয়নি।
সেটা আবার কী পণ্ডিতমশাই?
আরে বাবা হাতেখড়ি। ওটা না হলে তো
পাঠশালায় ভর্তি করা যাবে না।
আপনি করিয়ে দিন।
ওটা জলে করতে হবে।
কীভাবে হবে?
মাগুরমাছকে বলো,
ও ব্রাহ্মণ হাতেখড়িটা দিয়ে দেবে। তারপর ওদের নিয়ে এসো।
পিঙ্গচক্ষু কি আর করে ছেলে বউকে নিয়ে নদিতে
চলে এল। ছেলেদের হাতে খড়ি দিতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে মাগুরের পাড়ায় গেল পিঙ্গচক্ষু।
ওকে দেখে সবাই দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। ভাবছে মাগুরমাছ খেতে এসেছে। মাগুর মাছেদের
প্রবীন পুরুষ পৃথুরোমা মাছেদের কলধ্বনি শুনে বাইরে তাকালেন। অনুমান
করেছেন কিছু একটা হয়েছে, তবে বুঝতে পারছেন না। বাইরে
তাকিয়ে দেখেন, ভয়ঙ্কর দর্শন পিঙ্গচক্ষু বসে আছে। তিনিও দরজা খুললেন না। ভিতর
থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? এ
পাড়ায় কেন?
পিঙ্গচক্ষু হাতজোড় করে বলল,
ঠাকুরমশাই, আমার ছেলেদের হাতে খড়ি দিতে চাই।
পৃথুরোমা হেসে ফেললেন,
বলিস কি তোরাও লেখাপড়া শিখবি?
দিনকাল পাল্টেছে ঠাকুরমশাই,
লেখাপড়া না শিখলে চলবে?
পৃথুরোমা হাসলেন,কাল ছেলেদের নিয়ে আসিস হাতেখড়ি দিয়ে দেব।
পিঙ্গচক্ষুর মনে হল,
এখন অর্দ্ধে্ক পৃথিবীটা আমার।
(দুই)
তীক্ষ্ণবুদ্ধি সকালবেলা নয়-নয়টি কুমীরকে
ঘরের সামনে দেখে চমকে উঠেছিল। ভেবেছিল, কুমীরেরা
বুঝি আক্রমণ করতে এসেছে। বুকটা যে ভয়ে উথাল-পাথাল করেনি এমন নয়। সেই জন্যই ঘর থেকে
বাইরে আসেনি। ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কথা বলছিল। শান্ত মনে ধীরে ধীরে কথা
বলে ব্যাপারটা নিজের আওতায় আনা গেছে। ওরা চলে যাওয়া পর্যন্ত অস্বস্তিটা গুড়গুড়
করছিল।ওরা চলে যেতেই মনে খুব আনন্দ হয়েছে, একসঙ্গে সাত-সাতটা
কুমীরছানা ছাত্র পাওয়া গেছে ভেবে। আনন্দের বড় কারণ বাপ কুমীরটাকে বোঝাতে পেরেছে। এটাই
অনেক।
তীক্ষ্ণবুদ্ধির বউ বলেছিল,
পাঠশালায় কুমীরছানা নিও না। যারা আছে সবাই তৃণভোজী, ওরা মাংশাসী। বলা যায় না, পড়তে পড়তে হঠাৎ যদি পাশের
কাউকে কামড়ে দেয়।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি শুনে হেসেছিল কিছু বলেনি।
পিঙ্গচক্ষুর সাথে তীক্ষ্ণবুদ্ধির একটা
চুক্তি হয়েছিল। ছেলেরা রোজ পড়াশুনার পর বাড়ি যেতে পারবেনা। গুরুগৃহে থেকে পড়াশুনা
করতে হবে। পিঙ্গচক্ষুর একটু আপত্তি ছিল, তবে ওর বউ
শুনে বলেছিল, ছেলেদের দেখতে পারব না, এইভাবে
পড়ানোর দরকার নেই।
তাহলে কী হবে।
একটা সমাধান আছে,
রোজ সকালে আমাদের দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
বউএর কথায় পিঙ্গচক্ষু ভাবে প্রস্তাবটা খারাপ
নয়। রোজ সকালে একবার ছেলেদের দেখা পাওয়া। পিঙ্গচক্ষুর আর দেরি সয় না। তাড়াতাড়ি এসে
পণ্ডিতকে প্রস্তাব দিল, আপনার কাছে আমার ছেলেরা
থেকে পড়াশুনা করবে, এটা তো আনন্দের। আমি ওদের কবে দিয়ে যাব?
সব শুনে তীক্ষ্ণবুদ্ধি বলেছিল,
কাল সকালে নিয়ে এস।
(তিন)
সকলবেলা পাঠশালা খোলার আগেই পিঙ্গচক্ষু সাত
পুত্র নিয়ে হাজির। তাদের দেখে তীক্ষ্ণবুদ্ধির আনন্দ আর ধরে না। কারণ ছাত্র বাড়লেই
পণ্ডিতমশাইএর লাভ, তিনি পড়াশুনা শিখিয়ে তাদের
বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। বনের বহু প্রাণী এখন বিদেশে কর্মরত। কুমীরও তো ঐ চিন্তায়
ছেলেগুলোকে নিয়ে এসেছে।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি দেরি না করে নতুন ছাত্রদের
নাম জিজ্ঞাসা করল।
বড়জন বিদ্যাচক্ষু,
দ্বিতীয় জ্ঞানচক্ষু
তৃতীয় লক্ষ্মীচক্ষু
চতুর্থ শিল্পচক্ষু
পঞ্চম অন্ধচক্ষু
ষষ্ঠ সংস্কারচক্ষু
সপ্তম কৃষিচক্ষু
নামগুলো লিখে নিয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধি
পিঙ্গচক্ষুর দিকে তাকাল। চোখে চোখে দুজনে চুক্তি সই করল।
* * *
পিঙ্গচক্ষু ছেলেদের রেখে চলে যাচ্ছিল। তীক্ষ্ণবুদ্ধি
ডেকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার হঠাৎ ছেলেদের লেখাপড়া
করানোর ইচ্ছা কেন তৈরি হল।
একটা গল্প শুনে আমার মনে হয়েছে,
সবারই কিছুটা লেখাপড়া শেখা উচিত।
কী গল্প?
একদিন শুনলাম কোন এক দেশে নাকি খুব জলের
অভাব হয়েছে। জলের অভাব হতে পারে , আমি স্বপ্নেও কল্পনা
করতে পারিনা। জলে জন্মেছি, জলে বড় হয়েছি, জলেই জীবনপাত করছি। জলের জন্য কষ্ট হতে পারে ভাবতেই পারি না। যাই হোক সেই দেশে
দুটো কাক তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ে। যেদিকে যায়, শুধু মৃত পশু,
জলের চিহ্নমাত্র নেই। অনেক ঘোরাঘুরির পর তারা একটা পরিত্যক্ত কলসী
দেখতে পায়। কলসীর নিচে সামান্য পরিমাণ জল ছিল। অনেক কষ্টে ওরা কলসী কাত করেছিল,
কোনও কাজ হয়নি। আবার সোজা করে রাখল। তারপর দুজনে মিলে একটা একটা করে
নুড়ি পাথর এনে ফেলতে লাগল। একটা সময় জল ওদের নাগালের মধ্যে চলে এল। দেখে ওদের খুব
আনন্দ হল, আমরাও পারি। তাই জল পান করার আগে জয়ের আনন্দে একবার নেচে নিল। তারপর মনের সুখে জলপান করল। ওখানে আর থাকেনি। যেখানে জল নেই,
প্রাণ নেই সেখানে কী থাকা যায়? ঘরের ছেলে ঘরে
ফিরে এল।
কার কাছে শুনলে?
ওদের কাছেই শুনলাম। আর এটাও জানলাম,
ওরা আপনার ছাত্র ছিল। তাইতো ছেলেদের আপনার কাছে দিয়ে গেলাম।
নমস্কার পণ্ডিতমশাই।
নমস্কার।
(চার)
তীক্ষ্ণবুদ্ধি সাত-সাতটি কুমীরের ছানা
পেয়ে খুব খুশি। এই পাঠশালা খোলার পর থেকে শিকার আর করতে যেতে হয় না। ছাত্ররা আসে,দিন কেটে যায়। একদিন বনের রাজামশাই জিজ্ঞাসা করেছিল, আজকাল তোমায় বনে বাদারে ঘুরতে দেখিনা, কী ব্যাপার?
ও হেসে মাথা নিচু করে বলেছিল,
আমার ছাত্ররাই শিকার করে এনে দেয়।
তার মানে?
আমি একটা পাঠশালা খুলেছি।
কারা পড়ে?
বনের পশু এবং তাদের সন্তানেরা।
তুমি তো আমার অনুমতি নাওনি।
মহারাজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আচ্ছা আপনিও কি
চান না, আপনার সন্তানেরা উচ্চতর জীবন যাপন করুক?
কে না চায়?
তাই তো…
আমার নাতিদের কাল থেকে পাঠাব?
তীক্ষ্ণবুদ্ধি হাতজোড় করে করে বলল,
এই দলটার পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি নিজে আপনাকে খবর দেব।
এখন নয় কেন?
আসলে মহারাজ আমি তৃণভোজী আর মাংশাসীদের এক
সঙ্গে পড়াই না।
মহারাজ বলল, হুম।
(পাঁচ)
পিঙ্গচক্ষু সন্তানদের পাঠশালায় দিয়ে আসার পর
থেকে খুব আনন্দে আছে। লেখাপড়া শিখে যদি বায়সদের মত বুদ্ধিমান হয়,
তবু আগামীদিনে বাঁচার আশা থাকবে, নতুবা যা
দিনকাল আসছে, সব জাযগায় জল শুকিয়ে যাচ্ছে। বায়সরা দেখে এসেছে, মাইলের পর
মাইল শুধু মরা গাছ, মরা নদী আর মরা মানুষ।
ওর বউ ভাবছিল, সাতটা
ছেলে লেখাপড়া শিখে আসলে, ওদের জন্য বউ পাওয়া যাবে তো?
ওরা এই ঘোলা জলে থাকতে পারবে তো? আমি ওদের
সাথে কথা বলতে পারব তো?
তীক্ষ্ণবুদ্ধি রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিল,
রোজ সকালে কুমীর এসে সন্তানদের দেখতে চাইলে কীভাবে দেখাবে? এরা কি জমজের মত দেখতে? কোথাও তফাৎ নিশ্চয়ই আছে,
নইলে চেনে কী করে? তারপর ভাবল ঘুম নষ্ট না করে
ঘুমিয়ে নেওয়া যাক, যা হবার সকালে হবে।
* * *
সকালবেলা প্রাতঃকৃত্য সেরে ফুরফুরে মেজাজে তীক্ষ্ণবুদ্ধি
নদীর কাছে গেছিল পরিষ্কার হতে। গিয়ে দেখে ওরা এসে গেছে। ওরা মানে পিঙ্গচক্ষু আর
তার স্ত্রী।
তোমরা এত সকালে?
ছেলেদের দেখান পণ্ডিতমশাই!
একটু রোসো, স্নানটা
সেরে নিই।
ওরা বসে রইল।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি স্নান-আহ্নিক সেরে
অন্ধচক্ষুকে ওদের সামনে নিয়ে এল। কুমীর ছানার হাত ছাড়ল না,
একটু দূর থেকে তারা দেখল। পণ্ডিত বলেও দিল, গুণে
নাও।
অন্যদিকে অন্ধচক্ষুকে বলে এনেছে,
কথা বলবে না। কথা বললে কাল যা শিখেছ, সব ভুলে
যাবে।
সাতবারই অন্ধচক্ষুকে দেখাল, ওরা এক
থেকে সাত গুণে জলে চলে গেল। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। পণ্ডিত সিদ্ধান্ত নিল,
আজ সংস্কারচক্ষুর শেষ দিন।
* * *
পরদিন সকালে পিঙ্গচক্ষু আর তার স্ত্রী এল
সন্তানদের দেখবে বলে। এবারও অন্ধচক্ষু সবার হয়ে হাজিরা দিল। মা চেয়েছিল একবার আদর
করতে, কিন্তু পণ্ডিত রাজি হয়নি। কারণ গুরুগৃহে মাতাপিতার
ঘনঘন আসা উচিত নয়, তাতে সন্তানের ক্ষতি হয়। খুব কাছের বলে
অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয়দিন জ্ঞানচক্ষুকে নিয়ে যাওয়া হল
অরণ্যপরিচয় করাতে। জলের প্রাণী গাছপালা চেনে না। তাই চেনানো শুরু হল। সন্ধ্যায় সব
পশুপাখি ডেরায় ফিরে গেলে তাকে নিধন করা হল।
অন্ধচক্ষু ছাড়া অন্য চারভাই বুঝল দুজন কমে
গেছে। পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞাসা করল, সংস্কার আর জ্ঞান
কোথায়?
তারা তো আমাদের সঙ্গে থাকছে না!
তীক্ষ্ণপণ্ডিত হেসে বলেছিলেন,
যাকে যেখানে রাখতে হবে, আমি সেখানে রেখে
শিক্ষা দেব।
চতুর্থদিন অন্ধচক্ষু যথারীতি সবার হয়ে বাবা
ও মায়ের সামনে সাতবার উপস্থিত হল। পিঙ্গচক্ষু ও তার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর তীক্ষ্ণবুদ্ধির
মনে হল, চেষ্টা করলে সব হয়।
পঞ্চমদিন বিদ্যাচক্ষুর ডাক এল।
তীক্ষ্ণবুদ্ধির বাড়ির বধ্যভূমিতে মাথা নিচের দিকে এবং লেজ উপরের দিকে করে ঝুলিয়ে
দেওয়া হল। তীক্ষ্ণবুদ্ধি একটা বড় ছুরি হাতে দূর থেকে জিজ্ঞাসা করল,
তোমার নাম তো বিদ্যাচক্ষু,বল তুমি কী কী শাস্ত্র
জান।
সে কিছু বলার আগেই পণ্ডিত এক কোপে তার
সামনের ডান পা’টা কেটে দিল।
পণ্ডিতমশাই আপনি আমার ডান পা’টা কেটে দিলেন?
কথার উত্তর না দেওয়ার এটা শাস্তি।
কথা শেষ করতে না করতেই সামনের বাঁপা’টা এক কোপে কেটে দিল।
অঝোরে রক্ত পড়ছে। বিদ্যাচক্ষু বাবা-মা কার
কাছে পড়াতে পাঠিয়েছে? তার মানে সংস্কারচক্ষু আর
জ্ঞানচক্ষুকেও উনি মেরে ফেলেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি
আমার হাত-পা কেটে দিলেন!
তীক্ষ্ণবুদ্ধি দাঁতে দাঁত চেপে পিছনের ডান
পা’টা কেটে দিল।
বিদ্যাচক্ষু বুঝল তার আর বাঁচার উপায় নেই। তাই
মাথাটা নিচু করে বলল, আপনার কাছে বিদ্যাশিক্ষার
জন্য এসেছিলাম, আপনি আমার গুরুদেব, গুরু
নিন্দা করতে নেই। আপনি আমার প্রণাম নেবেন।
(ছয়)
তীক্ষ্ণবুদ্ধির হাঁটাচলা পাল্টে গেছে। বলতে
গেলে মাটিতে পা দিয়ে সে আর হাঁটে না। পশুরাজ ডেকে পাঠিয়েছেন,
যাওয়ার সময় নেই। রাজার পেয়াদাকে বলেছে, আমি
একটু বিদ্যাচর্চায় ব্যস্ত আছি। পশুরাজ
বিদ্যাচর্চা শুনে আর কথা বলেন নি। মনে মনে গর্ব বোধ করেছেন,
আমার রাজত্বে এমনও মানুষ আছেন, যিনি সবকিছু
ভুলে বিদ্যাচর্চা করেন। মুখে বলেছিলেন, আহা কী অপূর্ব সংবাদ।
(সাত)
রাজ প্রশংসায় তীক্ষ্ণবুদ্ধির দেহটা হালকা
বোধ হল। সেই রাতে লক্ষ্মীচক্ষুকে সবার থেকে আলাদা করে দিল। অন্যঘরে যাওয়ার পথে সময়
নিচ্ছিল। তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এত
সময় লাগছে কেন?
বলুন তো আমরা কতদিন কিছু খাইনি?
গরুগৃহে শিক্ষালাভ করতে গেলে উপবাসে থাকতে
হয়। ভরা পেটে শিক্ষালাভ হয় না।
লক্ষ্মীচক্ষু আর কথা বলতে পারে না। ধীরে
ধীরে তীক্ষ্ণবুদ্ধির কথা মত একটা ছোট কুঠুরিতে এসে ঢোকে। অন্ধকার সেই কুঠুরির দরজা
বন্ধ করে তীক্ষ্ণবুদ্ধি চলে যায়। সোজা হয়ে বসতে পারেনা,
শুতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে।
আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।দূর থেকে দেখে
তীক্ষ্ণবুদ্ধি নিজের ঘরে যায়।
পরদিন সকালে আগের মতই অন্ধচক্ষু বারবার
দর্শন দেয়। সে তো বোঝেনা কোথায় যায়, তীক্ষ্ণবুদ্ধির
কথা অনুযায়ী একবার করে গুরুগৃহে ঢোকে আবার বেড়িয়ে আসে। সাতবার হলেই সে গুরু
নির্দেশে নিজের জায়গায় চলে যায়।
* * *
লক্ষ্মীচক্ষু ক্ষুদায় কাতর,
তাকে মারা যাবে না। সবার অলক্ষ্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তীক্ষ্ণবুদ্ধি
সিধান্ত নিল, শিল্পচক্ষুকে ব্যবহার না করলে লক্ষ্মীচক্ষুকে
বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই অল্প অল্প করে শিল্পচক্ষুর বিনাশ ঘটাতে হবে। লক্ষ্মীকে
বাঁচাতে গেলে আর কোনও পথ নেই। তাই সন্ধ্যায় আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে খুব ধীরে
শিল্পচক্ষুর মরন ঘটে। তার মাংস দিয়েই লক্ষ্মীচক্ষুকে বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা করে
তীক্ষ্ণবুদ্ধি।
* * *
ঘরের মধ্যে রইল কৃষিচক্ষু,
এতদিনের নির্জলা উপবাসে সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকে। তীক্ষ্ণবুদ্ধি
অনুমান করে কৃষিচক্ষুকে খাবারে পাতে নিতে অসুবিধা হবে না।
* * *
প্রতিদিন অন্ধচক্ষু গুরুর নির্দেশে
বাবা-মায়ের সামনে হাজিরা দেয়। তীক্ষ্ণবুদ্ধি জলের মাধ্যে ভাসে থাকা বাবা-মা’কে বলে, ছ’মাস অপেক্ষা কর,
তোমাদের আর ভাবতে হবে না। সাতটা পণ্ডিত তোমাদের ঘরে আলো করে থাকবে।
(আট)
পশুরাজের বয়স হয়েছে,
তিনি আর শিকার করতে চাইছেন না। তাই একটা মহতীসভা ডেকেছেন। সেই সভার
সভাপতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি প্রস্তাব দিল, পশুরাজের রাজত্বে আমরা
নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে আছি। আমাদের বাপ-ঠাকুরদারাও ছিল। পশুরাজ আর শিকার করতে চাইছেন
না। অথচ দেহ খাবার চাইবে। শিকার না করলে খাবেন কী? তাই আমার
একটা প্রস্তাব আছে, প্রতিদিন উনি আমাদের বনের কাউকে শিকার
করেন। আমাদেরই কেউ না কেউ মারা যায়। অবশ্য
রাজার জন্য মৃত্যু সবসময়ে পশুকুল প্রার্থনা করে। আমরা কেন ঠিক করে নিইনা, আমরাই এগিয়ে যাব ওনার কাছে খাদ্যস্বরূপ। তাতে ওনার যেমন সুরাহা হবে,
আমরাও জানব, কে আগামীদিন পশুরাজের কাছে যাবে।
পশুরাজ শুনে অপ্লুত হয়েছেন। পণ্ডিত ছাড়া
একথা কেউ ভাবতে পারে না।
সভায় কেউ আপত্তি জানাল না।
* * *
তীক্ষ্ণবুদ্ধির পাঠশালায় ছাত্র সংখ্যা কমতে
লাগল। কারণ বনের একজনের রোজ প্রাণ যাবে। মরতে যখন হবে, তাহলে
পড়াশুনা করে লাভ কী?
তীক্ষ্ণবুদ্ধি বনের পশুদের বুঝিয়েছিল,
বনে অন্য কেউ রাজা হতে পারবে না। কারণ বনের রাজা আছে। কারও ঘাড়ে
দুটো মাথা নেই যে একটা মিটিং ডাকতে পারে। তাই পাঠশালা নির্মাণ। পাঠশালায় যেমন ছোট
ছোট শিশুদের পড়ানো হবে, বড়দের সঙ্গে আগামীদিনের পরিকল্পনা
করা যেতে পারবে। তীক্ষ্ণবুদ্ধির এই প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়ে গেছিল। একমাত্র
সুগ্রীব বলেছিল, তীক্ষ্ণবুদ্ধি বনের রাজা হতে চায়। তাই
পাঠশালার নামে সবাইকে সংগঠিত করছে। কারণ সুগ্রীব একমাত্র পশু যে জানে রাজা
পাল্টানো পরিকল্পনা ছাড়া হয়না।
* * *
সারারাত বৃষ্টির পর তীক্ষ্ণবুদ্ধি ভোরবেলা
ঘর থেকে বাইরে এসে দেখে বৃষ্টিভিজে একরাশ শশব্যস্ত কাঁপছে। কাছে গিয়ে আদর করে কী
হয়েছে তোমার, কাঁপছ কেন?
আজ আমার পালা।
কীসের?
পশুরাজের খাদ্য হতে হবে।
উপায় তো নেই। আমরাইতো ঠিক করেছি। একদিন
আমারও দিন পড়বে। চিন্তা করে কোনও লাভ নেই।
আমার ঘরে ছোট শিশুরা রয়েছে,
তাদের কী হবে?
চিন্তার বিষয়, কিছু
একটা করা উচিত। প্রস্তাব দেওয়ার সময়ে একবারও মাথায় আসেনি, একদিন
তীক্ষ্ণবুদ্ধিরও পালা পড়বে। প্রস্তাব সবার জন্যই ভয়ঙ্কর। সে শশব্যস্তর কানের কাছে
গিয়ে নিচু গলায় কিছু বলল। যেখানে যেখানে বুঝতে পারল না, সেখানে
আবার জিজ্ঞাসা করে নিল।
সূর্য উঠেছে, বৃষ্টিতে
ভেজা বনের গায়ের সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে। তরুণ শশব্যস্ত ধীর পায়ে পশুরাজে
গুহার দিকে এগিয়ে চলেছে। তীক্ষ্ণবুদ্ধি দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বলছে, দুগ্গা দুগ্গা।
শশব্যস্ত চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যে
বায়স এসে খবর দিল, পশুরাজ কুঁয়োতে নেমেছেন,
কুঁয়োতে নাকি আরেকজন পশুরাজ আছেন। তিনি তাঁকে মারতে গেছেন। এখনও উঠে
আসেন নি।
(দশ)
সুগ্রীবের সন্দেহ অমূলক। কারণ সে তো জানে
রাজা হতে চেয়ে কোন পথ তাকে বেছে নিতে হয়েছিল। পশুরাজ আর কুয়ো থেকে উঠে আসেন নি। সূ্র্য
অস্ত যাওয়ার আগেই তীক্ষ্ণবুদ্ধি নিজেকে বনের রাজা ঘোষণা করল। চারদিকে রটে গেল
পশুরাজ বার্দ্ধক্যজনিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন পণ্ডিত
তীক্ষ্ণবুদ্ধি।
* * *
জয়নারায়ণ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন,
অনেক রাত হয়ে গেছে। বললেন, এরপরে বনের রাজা হল
পিঙ্গচক্ষু। কুমীররাজের ঘটনাতো আপনারা সবাই দেখছেন, বুঝছেন
এবং সবটাই জানেন।
এক বৃদ্ধ বললেন,
ঠিক বুঝলাম না গল্পটা।
জয়নারায়ণ উঠে দাঁড়িয়েছেন, প্রশ্নটা শুনে ঠোঁটে হাসির আভা দেখা গেল। মুখে বললেন, সবার শুভ হোক। 🚫
চিরঞ্জয় চক্রবর্তী |
প্রকাশিত গ্রন্থ
উপন্যাস
বোকা প্রপিতামহ কথা
খেলার অবসর বা অবসরের খেলা
মহাশয় শুনঃশেপ (তৃতীয় উপন্যাস)
শ্রীরামকৃষ্ণ নুনের পুতুলের রামযাত্রা (পাতাবাহার)
দুই শালিক নমস্কার (শিশুসাহিত্য)
গল্পগ্রন্থ
শ্রেণী শত্রুদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা (প্রথম গল্পের বই)
শ্রীশ্রীগণপতিবাবা সহায়
আজ রবিবার আজ নৃসিংহ পূজা
সুকু খেলা (গল্প সংকলন, বাঙলার মুখ, ২০১৮)এই হনুমান কলা খাবি
পাঠক কী কী খায়
যৌবনঘন রসময় (স্বামি বিবেকানন্দকে নিয়ে প্রবন্ধ সংকলন; তথাগত)
বই পড়বই/ কেন, কেমন করে, কী বই
কর্মযোগ এখন
আইনস্টাইনের কবিতা (মূল জার্মান থেকে)
সম্পাদিত গ্রন্থ
অব্যয় গল্প (দ্বিতীয় খন্ড)
বসতবাড়ি ৫০
কর্মশিক্ষার বই
সহজ পদ্ধতিতে মোমবাতি
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
0 মন্তব্যসমূহ