সাইন্যাপস্ পত্রিকার একটি ধারাবাহিক কলাম 
কবিতা ভাবনা। 
প্রতি সংখ্যায় কোনো কবি কলম ধরবেন 
কবিতা বিষয়ে তার নিজের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার জন্য। 
সঙ্গে থাকবে তার নিজের স্বনির্বাচিত 
একটি বা দু'টি কবিতাযা প্রতিনিধিত্ব করবে 
কবির কবিতা-দর্শনের। 
সাইন্যাপস্ পত্রিকার জন্য এই কলামের 
চতুর্থ কবিতা ভাবনা লিখলেন 
হাবড়ার সুপরিচিত কবি অমিতাভ দাস। 

সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা কবিতা ভাবনা ৬ 

কবি উৎপল ত্রিবেদী

চিরসখা হে


    সন্ধ্যা হয়ে এল ওই/আর কত বসে রই/তব রাজ্যে তুমি এসো চলেঠিক এই শব্দে আমার সাথে এখন তার রোজ, নানাক্ষণে কথা হয়। সে আমার আরাধ্য নয়, বরং আমার আজীবনের অনিবার্য্য অপরাজেয়, অপরাহত প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা বহুবার মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিবার সে হেসে, মাথা নেড়ে সরে দাঁড়িয়েছে মূল দরজা ছেড়ে। তার দীর্ঘ ছায়া ঘরে যেতেই নিজেকে বিজয়ী ভেবে উল্লাস করেছি আর তখনই যে আরেকবার উঁকি দিয়ে তার  অস্তিত্বের জ্ঞাপন দিয়ে চলে গেছে। ইনি মৃত্যু। আমার জীবন যাপনের অবিচ্ছেদ্য দোসর, ঠিক যেমন কবিতা।

       আমার কবিতা বাহিত জীবনের বয়স (কঠিন পথে লেখার হিসাব ধরে, পাঠ বাদে) ঊণপঞ্চাশ বছর। এর প্রায় অর্ধেক, ধরা যাক পঁচিশ বছর, মৃত্যু ভাবনার সাথে নিবিড় সখ্য ছিল। মৃত্যু ভয়কে জয় করতে করতে কখন সে মৃত্যুকেই বুকে বেঁধে বাইতে শুরু করেছিলাম যে এখন আর তেমন স্পষ্ট নেই স্মৃতিতে। তবে মনে আছে, যখন আমি নবম-দশম শ্রেণীতে তখন বিপ্লবী আন্দোলনের হাত ধরে এক আত্মক্ষয়ী হনন যজ্ঞের সূচনা হয়েছিল। তার যখন বিপুল বিস্তার, যখন তার লেলিহান শিখায় পুড়ে আঙার হয়ে যাচ্ছে গোটা একটা প্রজন্ম, তখন আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পাশাপাশি বিপ্লবী তত্ত্বেরও পাঠ নিচ্ছি। নাটকের মঞ্চে, মহলায়, আবৃত্তির আসরে প্রতিদিন মৃত্যুর গন্ধ বওয়া বিপ্লবকে ছুঁয়ে থেকেছি। কল্যাণী রবার্টসন কোয়ার্টারের মাঠে যেদিন নিজের চোখের চোখের সামনে বন্ধু কমরেড ইয়াসিন আলি মোল্লার পেট চিরে নাড়ি ভুঁড়ি বার করে দিতে দেখি জনা কয় প্রায় পরিচিত যুবককে, সেদিন থেকে মৃত্যুভয়কে জয় করে ফেলার শুরু। সেদিন থেকে বাঁক ফেরে কবিতা। জীবনের অগণিতচঞ্চল পুলক রাশিনিখিলের মর্মে এসে লাগলেও আমার কাছ থেকে রূঢ় প্রত্যাখ্যান পেয়ে ফিরে যায়, কবিতা আবার বাঁক ফেরে। একবার-দুবার-বারবার। এক তীব্র অতৃপ্তি ছুটিয়ে বেড়াতে থাকে কবিতার এক মাথা থেকে অন্যমাথায়।

       একটা জেদ ছিল শুরু থেকেই যা লিখি, যেমন লিখি, পাশ-ফেলের কূটতর্কে তাদের স্থান যেখানেই হোক শরীরে-মননে আমার প্রতিটি লেখা যেন এক ভারতীয়ের আর স্পষ্ট করে ভাঙনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৃহত্তর জাতি-ধর্ম থেকে সমাজ, মায় একান্ত ব্যক্তিগত মানসবিন্যাস ভেঙে পড়তে দেখা এক বাঙালির লেখা যেন হয়। এমন নয় যে বিদেশি কবিতার প্রতি কোন দ্বেষ ছিল। কখনোই নয়, বরং আমি আজো পূর্ব-ইউরোপের কবিতার ভক্ত পাঠক। পোপা, হোলুব, পাররা, রুজেভিচরা আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে বসে আছেন। আমি আজো প্রথম দিনের সমান বিষ্ময় বোধ করি তাঁদের কবিতা পড়তে গিয়ে। দুদুটো মহাযুদ্ধ আক্ষরিক অর্থে শেষ করে দিয়েছিল পূর্ব ইউরোপকে। তবু কি আশ্চর্য স্পর্ধায় তাঁরা মৃত্যুর-ধ্বংসের-ভাঙনের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে জীবনকে ভেবেছেন। আজো কবিতা চেষ্টার ফাঁকে-ফাঁকে আমি উচ্চারণ করি — “আমাকে উশকিয়ো না তুমি, টাগরার খিলান, আমি সমস্ত চিবিয়ে খেতে উদ্যত হয়েছিআর — ‘কাকে বলে কবিতা যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা জাতিকে?’

       ধর্মপ্রাণ মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাস্ত্র আওড়ান। আমি নির্লজ্জ কবিতাপ্রাণ। সুতরাং আমারো আওড়ানোর মন্ত্র আছে বইকি। থাকতেই হয়। হোক সারোগেটেড, তবু দাঁড়ানোর মাটি তো চাই, চাই-ই। আমি তো জানি কারো নির্দেশে আমার পথ চলা নয়, আমার জীবন আমি স্বেচ্ছায় যাপন করি। সাতষট্টি বছরের রোগজীর্ণ, প্রায় বুড়ো এই বুকটা চাপড়ে অন্তত এটুকু তো বলতেই পারি। তাই নিজের বিশ্বাসের কাছে এসে আজো ছায়া পাই, আজো পথ দেখি শঙ্খ ঘোষের কথায় — ‘কবিতার সত্যি কথা বলা ছাড়া কোন কাজ নেই। কিন্তু শ্রেণীবশে, জীবিকাবশে এতো মিথ্যায় জড়িয়ে আছি যে সত্যের চেহারাটা স্পষ্ট করে দেখতে পাই না।

        এত বছরের অভিজ্ঞতায় জানি যে এই মিথ্যার ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গিয়ে যে আবছা চেহারাটা দেখা যায় সেটা সত্য নয়, সত্যকল্পও নয়। সেটা নিতান্তই আবছায়া। আর তাকে নিয়েই বৃত্তের বাইরে থেকে অনেকের কবিতা বাণিজ্য চলে। তাদের নামে জয়ধ্বনি ওঠে, করতালিতে মুখর হয় আকাশ-বাতাস, আর এই মিথ্যে মায়ার আড়ালে ক্রমশ সরে যেতে থাকেন শঙ্খ ঘোষ, বেদখল হয়ে যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃতদেহ, উচ্চকিত (পড়ুন লিফলেট) কবিতা লিখতেন এই অজুহাতে নস্যাৎ হয়ে যান মণিভূষণ ভট্টাচার্য্য; নবারুণকে অজুহাত করে রাখা হয়। বাংলা কবিতা গভীরতর খাদে গিয়ে পড়ে। 

(দুই)

       যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে আরেকবার ফেরা যাক। মৃত্যুকে ডাক দিয়ে আরম্ভ হয়েছিল, অথচ এতক্ষণ যা লিখলাম তার সবটাই মৃত্যুর বিপরীতে জীবনের কথা, নানাছলে। দুটো দিক ভাবা যেতে পারে, এক মৃত্যুকে ছুঁয়ে তাকে অতিক্রম করার একটা সচেতন প্রয়াস হতে পারে। এখানে একটা দৈবিক প্রশ্ন আসতেই পারে কে হে বাপু তুমি, মৃত্যুকে অতিক্রম করতে এলে?” জানি, মৃত্যু অনতিক্রম্য। কিন্তু যদি তার চোখে চোখ রেখে লড়াইটা দিতে পারি তাহলে অন্ততহেরোআখ্যা পেতে হবে না। চিরকাল শুনে এসেছি কবিরা একটু আলটুসি, ‘সখী ধরো-ধরো’ — গোছের হন। এক্ষেত্রে যে অপবাদটা মুছতে পারে, না মুছলে খুব তেমন মহাভারত হয়ত অশুদ্ধ হয় না, তবু নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে ব্যাপ্ত পৌরুষ আমাদের মানবিক পরিচয় সে এই পরাজয়ে বেশ খানিকটা মায়ুশ হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক। তাই এই অসম লড়াই থেকে কিছুটা সম্মান আদায়ের প্রয়াস।

       দ্বিতীয়তঃ মৃত্যু তো শরীর যন্ত্র, সম্পূর্ণভাবে বিকল হবার অন্য নাম। যন্ত্র বিকল হবেই, আজ হোক বা অন্যদিন, কিন্তু মানুষ তো কেবল শরীরমাত্র নয়, যন্ত্রের বাইরেও তার এক যন্ত্রণাবিদ্ধ পরিচয় আছে। কখনো সেখানেও বিকলন আসে। কেন আসে তার নানান বৈষয়িক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু যেই সব মেধা গ্রাহ্য তর্ক এড়িয়েও ভাবতে পারি অন্যভাবে। আমাদের সাধ্য নেই জীবনের প্রিয়তম দিনটির আয়ু, এক মুহূর্তও বাড়ানোর। তাই যখন জীবনের ঘর দুপুর তখন পরিপূর্ণ করে বেঁচে থাকা কর্তব্য। জীবনের শ্রেষ্ঠ নির্মাণ ওই সময়েই সাধ্য। কারণ ঐ সময়েই সাধ সামর্থকে প্রতিস্পর্ধী দেখাতে পারে। পারে বলেই যখন দিন সন্ধ্যার অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায় সেই সীমাহীন দিকশূণ্যতায় অস্থির করে না অস্তিত্বের ফেলে আসা বাঁকগুলিকে। মৃত্যুকে তো এড়ানো যাবে না। আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজের ক্ষতি। ভ্রান্তিবিলাস সাজে না সুর্বিপাকে।” (সুধীন্দ্র নাথ দত্ত)। তাহলে কি সাজে? শান্ত-স্থির সমর্পণের প্রেক্ষিত নির্মাণটুকুই থাকে। কি আশ্চর্য, জীবনানন্দ জানতে চেয়েছিলেন সমুদ্রের ঢেউয়ে জীবন ফেরী করা নাবিকের কাছে হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি?” ওপরের আপাত সাযুজ্যহীন গদ্যকথাটির সাথে এক প্রায় অসম্পূর্ণ মানুষের কবিতা কথা এইখানে এসে অদ্ভুত মিলে যায়।

       সময় বা কালখন্ডের সাথে সৃষ্টির একটা অনিবার্য সহগামিতা আছে। এই সহগামিতাকে কাজে লাগিয়েই সৃষ্টি, সে কবিতা-গল্প-উপন্যাস জাতীয় হোক বা শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম হোক, সময়কে অতিক্রম করে দূরদর্শী হয়ে ওঠে। ওঠে কিনা, বা কেন মাত্র কেউ কেউ-ই তেমন হতে পারেন সে নিয়ে বিস্তর তর্ক থাকা সম্ভব। আমরা সে তর্কে আপাতত প্রবৃত্ত হবনা যদিও তবু এ উল্লেখে তর্ক নেই যে যেমন সকলেই কবি বা পাঠক হয়ে উঠতে পারেন না তাঁদের ক্রিয়া যত পল্লব গ্রাহীতার কারণে সম্ভবত তেমনি দর্শনের বিশ্লেষণে অনীহা এবং সৃষ্টির গভীরে যেতে না চাইবার অপরিণামদর্শিতা সময়কে অতিক্রম করার দক্ষতা কেড়ে নেয়। সময় তো কেবল একটি তিন অক্ষরের শব্দ সমষ্টিমাত্র নয়, সে আরো অনেক ব্যাপ্তি দাবী করে, অনেক গভীরতা, বহু ঘূর্ণিজল অতিক্রম করে তবেই সময়ের তট খুঁজে পাওয়া যায়, সে পথ এবং পদ্ধতিও বড় সরলীকৃত নয়। 

(তিন)

       আমি এবং আমার মতো অনেকে যখন এই পৃথিবীতে হাজিরা দিলাম তখনো আমাদের দেশের শরীর থেকে ইওরোপের গন্ধ যায়নি। যে দেশটা থাকার কথা ছিল সে দেশটাও নেই। দ্বিখন্ডিত। যে প্রীতিস্নিগ্ধ সম্পর্কে পূর্বজেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পর্কিত থাকতেন তা উধাও। সংশয়, অবিশ্বাস এবং ঘৃণা নিয়ে একে অন্যের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। তখন কেউ আর মানুষ নয়। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান এবং নিয়ন্তাদের ইচ্ছায় নিয়ত বিবদমান।

       সে এক আশ্চর্য ভাঙনের কাল। বিশ্বাসের পাড় রোজ ভাঙছে কোথাও না কোথাও, কোননা কোন ভাবে। মধ্যচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দশকে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের কবিতায়-গল্পে-উপন্যাসে-ছবিতে-চলচ্চিত্রে বারংবার সেই ভাঙন উঁকি দিয়েছে।সৃষ্টির মনের কথা, মনে হয়, দ্বেষহয়তো। অথবা হয়তো নয়। আসলে এই দ্বেষ খুব যত্ন করে আকাশ-বাতাস-সমুদ্র-নদীর কণায়-কণায় ছড়ানো হয়েছে আর আমরা তারই উত্তরাধিকার বয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের সৃষ্টিতে।

       এ সময়ে এমন বিষভরা পরিবেশে কি কবিতা হয়? এ প্রশ্ন আঠারো শতক থেকে নানা পোষাকে হাজির করানো হয়েছে। আজ এই ফেসবুক নির্ভর সাহিত্যের কালেও সেই একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে — “এই পরিবেশে, এই পরিস্থিতিতে কবিতা কিভাবে সম্ভব? কি কাজ কবিতার আজো? জীবনে বহুবার বহুকারণে নিজের যে বিশ্বাসের কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছি, জীবনের সন্ধ্যার মুখে দাঁড়িয়েও যে বিশ্বাসেই অটল আছি, শুধু আমাদের এই একটুকরো রাজ্যে বা দেশেই কেন গোটা পৃথিবীর কোথাও কবিতার কোন চিহ্নও থাকতোনা যদি যে ঘটনাক্রম কোনভাবে ইতিহাসের নিয়ন্তা হবার ক্ষমতা রাখতো। দুদুটো বিশ্বযুদ্ধ, আউশভিচের গণহত্যা, থেকে সাম্প্রতিক অতীতের গোধরাকান্ড পর্যন্ত সকলেই শেষতক সময়ের প্রবাহের কাছে এবং মানুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে হাঁটুমুড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে, যত তীব্র হয়েছে আঘাত, তত প্রখর হয়েছে প্রতিরোধ, উচ্চকিত হয়েছে কবিতা। তাই প্রেমের কবিতার পাশাপাশি ঐতিহাসিক কারণেই লিফলেট জাতীয় কবিতা জন্মেছে। কোন যুদ্ধে কোন অস্ত্র যথার্থ আঘাত হানতে পারে তা সিংহ হৃদয় যোদ্ধাই জানে।

       তাই রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে যেখানেই যাই, কবিতা আমার সঙ্গে চাই। 

(চার)

You see things, and you say ‘why’?

But I dream things that never

And I say ‘why not’?

 

 বার্ণার্ডশএই কথাগুলো ঠিক কোন পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন সে কথা এখন আর স্মরণে নেই, তবে আমার মতো পাঠকের কাছে এটা কবিতার অন্তর্লীন ব্যাখ্যা। হয়তো ভুলও হতে পারে। হোক। কী আসে যায়! আজি তো বোধে এবং নির্বিদ্ধিতায় সেই পুরাতন আমিই। ঠিক-ভুল যা আছে তা নিজেরই আছে। তো, কী আছে? — এসব কথার কি কোন সোজা জবাব হয়? জীবনের অধিকাংশ সোজা কথার কোন সোজা জবাব হয়না, প্যাঁচালো হয়; আমার কবিতা বোধের মতো আলোময় ঘরে প্রদীপ জ্বেলে অন্ধকার খোঁজার মতো।

       শুরু হল খোঁজ। খুঁজতে খুঁজতে কতদূরে যেতে বল মন/কতদূর নদী পারাপার/কতখানি চড়ার আড়ালে/কতটুকু সুখের আধার?” খোঁজা মানে তো নিজের ভিতরে হারিয়ে যাওয়া; অন্তহীন। ফলে চলো, চলো, চলতে থাকো। বাহির থেকে ভিতর হয়ে আরো ভিতরে। পিছন ফিরে হাঁটছি তো হাঁটছিই। একসময় ভুল হয়ে যায় কোনখান থেকে শুরু হয়েছিল? মনে থাকেনা কোথায় পৌঁছাতে হবে, কেবল এক অদৃষ্টপূর্ব স্বর্ণমৃগয়াকে খুঁড়ি।

       ঊনপঞ্চাশ বছর পার করে ফেলে কবুল করি সে আজো প্রথম দিনের মতোই অচেনা-অধরা। সে আজো চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়।বাহিরের দেশে-কালেতাকে ঠিক কোন পরিচয়ে চেনা যাবে, অথবা কেমন করে তার ছড়িয়ে থাকা স্বরূপকে গেঁথে তৈরি করা যাবে আমার আরাধ্য কবিতা প্রতিমা তা এই আলো কমে আমার দিনেও জানতে পারিনি। তাদের পরে শব্দ গেঁথে কবিতার পুরোহিত সাজা কঠিন নয়, কিন্তু নিজের কাছে, মধ্যরাতের অনিদ্রার কাছে, দ্বিপ্রহরের একাকীত্বের কাছে কি উত্তর?

       প্রণব ঘোষ লিখছেন, আমার কবিতা তোর পায়ে পায়ে/নতশিরে যাবে শ্মশানেও/তুমিই আমার প্রেয়সী শ্রীরাধা/আমার কবিতা শোনো। মনে হল বাহ্‌, এই তো দিব্য সহজে বোঝা গেল। কিন্তু ছবিটা ভাবতে গিয়ে টের পেলাম বুঝেছি মনে হওয়া আর বুঝে ফেলার মধ্যে বিস্তর ফাঁক আছে।প্রেয়সী শ্রীরাধাশব্দবন্ধের আপাত সরলতা কিন্তু দুবারকবিতাশব্দের ব্যবহারে অটুট রইল না। একটা কোথাও খোঁচা থাকছেই।কবিতাশব্দটি দুবার যেন একই দ্যোতনা বহন করছে না, বরং এরা একে অন্যের ওপর অন্যতর বোঝা চাপিয়ে কবিকে নিশ্চিন্ত করছে। আবার অন্যটাও নাছোড়। যদি এরা এক না হয় তবে কি এরা অন্য? এরা কি একেরই অন্য? নাকি অন্য এক যা দৃষ্টি এবং শ্রুতিতে বিভ্রম সৃষ্টিকারী অতিনির্ণয়? এইভাবে যখন গোলমালটা পাকিয়ে উঠছে তখন এটা বোঝা যাচ্ছে যে কবিতায় এক এবং অন্য, ভাষা বা তত্ত্বের ফেরে অন্যের এক বা একের অন্য আছেই। সেইটা খুঁজতে হবে। কোথাও একটা ধোঁয়াটে ব্যাপার আছে। মাকড়সার জাল একটা। একটা গভীর ষড়যন্ত্র নাকি? প্রদীপ জ্বেলে খুঁজতে হবে। পলতে পাকানো যাক।

       এক আর অন্যের এই একান্নবর্তিতা বা অন্যবর্তিতার হাঙ্গামায় যখন বেজায় জেরবার, যখন একতর অন্য আর অন্যতর একের জট খুলতে লাগল; যখন এইসব কথার প্যাঁচে বা প্যাঁচালো কথায় কবিতার হারিয়ে যাবার উপক্রম তখন শঙ্খ ঘোষের বাউল বলল বলেছিলাম, তোমায় নিয়ে যাবো অন্য দূরের দেশে/সেই কথাটা ভাবি/জীবনের ওই সাতটা মায়া দূরে দূরে দৌড়ে বেড়োয়/সেই কথাটা ভাবি। সে আরেক হাঙ্গামা, বাউলের পাল্লায় পরে ঠিকানা গে হারিয়ে। কোথায় যাবে সে? কোন দেশে? আছে বুঝি কেউ তার আপনার সেই দেশে? কিন্তু কাকে নিয়ে এত কথা? যে আছে আপন খুশিতে তাকে অন্যের (পড়ুন কবির এবং পাঠকের) ইচ্ছেয় কি করে বাঁধা যাবে? হাতের নাগালে থেকেও সে চির অধরা। দৃষ্টির কাছেই আছে কিন্তু তার রূপের বাখান করতে পারি কই? তাই শব্দের ধন্দ্বে কিংবা শব্দমোহের চাকায় আদর্শকে জড়িয়ে নিয়ে কেটে যায় আস্ত জীবন।

(পাঁচ)

       এমনিতেই আমাদের পায়ের নীচে যা আছে তা আমাদের নিজস্ব নয় কৃত্রিম ভূমি। যেখানে দাঁড়িয়ে কর্তাভজা ছাড়া তো আমাদের আধিকাংশ কবিরই কোন উদ্দিষ্ট নেই, তার ওপরে শাকের আঁটির মতো যদি যে কোন শব্দ সমষ্টিতেই কবিতা খুঁজতে চাই তাহলে সেটা বোধহয় বিশুদ্ধ আঁতলামি ছাড়া আর কিছু হয় না। 

       তবু কৃত্রিম ভূমি শব্দটা ভাবায়, সত্যিই কি আমাদের কোন স্ব-ভূমি নেই? দেখতে হবে। সলতে পাকানো যখন শুরু হয়েছে তখন সবদিকেই আলো ফেলে দেখতে হবে। দেখতে হবে কতটা কবিতা বদমায়েশি আর কতটা বদমায়েশি কবিতা। কবিতাকে খানিক উল্টে-পাল্টে, মানেআপসাইট ডাউনকরে, খানিক তার রূপ আর কল্পকে বদলে ফেলে দেখতে হবে। তার যাবতীয় নাকে কান্না, অভিমানে ঠোঁট ফোলানো, কোমর দুলিয়ে, নিতম্বে ঢেউ তুলে, ইশারায় বান হেনে চলা থেকে টেনে বার করে নিয়ে আসতে হবে প্রকাশ্য রাস্তায়। তারদিকে আঙুল তুলে সবাইকে ডেকে বলতে হবে ভদ্রমহোদয়/মহোদয়াগন, দেখুন, এই হল কবিতা 

        

       কিন্তু প্রকাশ্যে টেনে আনলেই কি তার কোন গুণগত পরিবর্তন হবে? আশা কম। বরং বদলাতে হলে প্রথমেই একটু হ্যাঁচড়া-হেঁচড়ি করতে হবে তার ললিত লবঙ্গলতা কান্তিটিকে নিয়ে। বেশ জুত করে রোদে পুড়িয়ে গায়ের রঙটাকে অনেকটা আমাদের মতো উষ্ণ দেশের মানুষের কাছাকাছি আনতে হবে। তারপর ভেজাও বেশ করে, চারদিক অন্ধকার করে পৃথিবী ভাসানো বৃষ্টির মধ্যে তাকে একলা ছেড়ে দিতে হবে মাটির গন্ধময় মাঠে, যেখানে সে একা একা কেবলই ভিজবে, — আনন্দে হোক বা দায়বদ্ধতায়। মোটকথা তাকে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে মহেন্দ্র দত্ত বা কে সি পাল হতে হবে, এরপরেও চাইলে একটু বালি খোলায় ফেলে নেড়ে চেড়েও নেওয়া যেতে পারে। তাতে রূপের বেশ একটা সর্বজনীন খোলতাই হবে। একটু পোড়া, একটু স্যাঁতলানো, একটু কাঁচা। কোথাও কালো, কোথাও তামাটে, কোথাও বা অবিরল রূপবতী।

       এই রকম একটু উল্টে-পাল্টে নেবার অ্যাপ্লায়েড পাগলামিটা না করতে পারলে কবিতাটা ঠিক ঠিক ধরা  মুশকিল, আপনারা অবশ্যই জানেন যে এই রদবদলটাও আসলে আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। মূল ফুসলানিটা এখানেও কবিতারই। সেই আমাদের ইশারায় ডাক দেয়। আমাদের তো চরিত্রের বালাই নেই, তাই কবিতার যে কোন ডাকেই অদৃশ্য লেজ ঢেকে ঢুকে দৌড়াই তার পিছনে। তা যদি দৌড়াই তো কি হয়েছে? বেশ করি দৌড়াই। কে না দৌড়েছে বলুন তো? আমাদের ঊর্দ্ধতন একশো পুরুষ বা তারো বেশি সময় ধরে সবাই দৌড়েছেন, এবং পরবর্তী হাজার পুরুষ অবশ্যই দৌড়াবে, বেশ করবে। একটু ভাবলে দেখবেন এই বিরামহীন দৌড়টাই কবিতার সর্বজনীনতার সবচেয়ে বড় পরিচয়। যে যতোই বলিনা কেন, তেমন তেমন অবস্থা হলে সব দাদা-কাকাই এসে কবিতার দোরগোড়ায় একবার মাথাঠুকে যায়। ব্যক্তিগত জীবনে প্রথম প্রেম থেকে স্বপ্নভঙ্গ পার হয়ে চিতায় স্বাহা হওয়া ইস্তক অনেক মিছিল আসে কবিতা মন্দিরে। আত্মকলহ ব্যতীত অন্যান্য যাবতীয় সর্বজনীনতার তো আর একটাই ব্যাখ্যা নয়। যে কেউ, যে কারো মত করে ব্যাখ্যা করে নিতে পারে। আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে নিজের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে যে কাউকে ধর্মবাপ বানানোর। আমাদের কবিতায় এই মস্তান সর্বজনীনতার গ্রহণযোগ্যতাই সবচেয়ে বেশি। আমাদের সর্বজনীন মূর্খতা ছাড়া এটা সম্ভবত আর কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়।

       বদল যা হয়েছে তা এই যে, কেউ কেউ এটা ধরতে পারছেন। কয়েকজনের কবিতা পড়ে কিন্তু তেমন একটা আভাস বেশ পাওয়া যায়। ভয় পেলেন তো? ভাবছেন — এইরে, এইবারে এই লোকটাও কজন বিখ্যাত কবির কবিতা ওপর-নীচ করে নিজের ওস্তাদি দেখাবে। তা বাবা, সেই যদি নোলক খসাবি তাহলে এত ফুটেজ খাবার কি দরকার ছিল? সোজাসুজি বললেই হত।

       সবিনয়ে বলি, তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই। খ্যাত-অখ্যাত কোন কবি কেমন লেখেন এবং কেন সে আলোচনা করার জন্যে যথেষ্ঠ পন্ডিত মানুষেরা আছেন। তাছাড়া খ্যাতি শব্দটা, আমার কাছে, বেশ ভ্রমাত্মক। খ্যাতি, অন্তয় আমাদের দেশে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় যোগ্যতার চেয়ে বেশি করে প্রতিষ্ঠানের কৃপায়, এখানে আনুগত্যই প্রধান। বামফ্রন্ট জমানার শেষ দিকে একটা কথা চালু ছিল — ‘তুমি সি পি এম করো কিনা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা কার গ্রুপে আছো।খ্যাতি অমনিই। জানি অনেকে ভীষণ রেগে যাবেন, ফালতু, মিথ্যে কথা, নির্লজ্জ পরশ্রীকাতরতা বলে ভয়ঙ্কর তর্ক করতে চাইবেন। তবু আমি ওপরে লেখা একটা শব্দও ফিরিয়ে নেবনা, ওগুলো আমার সত্যি। আমাদের তো সব দেখে শেখা আর শিখতে শিখতে দেখা। পড়ে জানাতে অভিজ্ঞতার রসে ডুবিয়ে ছিঁড়ে-কেটে পাওয়া। এই যে এতগুলো বছর কেটে গেল কত মানুষ মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেশ সামলে গেলেন, কতোজন আচমকাই মুখ থুবড়ে পড়লেন। সবই তো প্রতিষ্ঠানের কৃপা। কতো যে ম্যাজিক আছে আস্তিনের নীচে বোঝা ভারি মুশকিল, খানিক মজারও।

       এই সব নিয়েই কবিতা, আমার আজম্ন সঙ্গী। শেষে আরেকবার শঙ্খ ঘোষকেই স্মরণ করি

সেই সনাতন ভরসাহীনা, অশ্রুহীনা

তুমি আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না?

তুমি আমায় সুখ দেবে, তা সহজ নয়

তুমি আমায় দুঃখ দেবে, সহজ নয়।”🚫


কবির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি কবিতা

আমি কারও সত্যকাম নই

এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে — রবীন্দ্রনাথ


সন্ধ্যাতারার কাছে একটি ফুলের নাম ভিক্ষা করি

সে আমাকে রাত্রির আকাশ থেকে স্রোতস্বিনী নদী দেয়,

প্রবাহিত তরঙ্গিণী বেয়ে হয়-মুখ, পঞ্চশির নাগ দেবতাও আসে

মাথায় সাজানো পারিজাত।

এ কোন কৌতুক!

আমার তো গাঞি-গোত্র-কুলশীল সমস্ত অজানা!

পিতৃ পরিচয়হীন — মাঠে মাঠে স্বপ্নের ঠিকানা

আর জননীর মৃতদেহ ঘিরে প্রত্যহ ছিটানো যত্নে ফুলের নির্যাস।

 

আমাকে মন্ত্রণা দাও — কীভাবে শব্দব্রহ্ম রোধ করি,

যে-নদীর স্রোতে পাড় ভেঙে গেছে

কোন যন্ত্রণায় তাকে অবরোধ করি!

পূর্ণিমার থেকে মাত্র এক পক্ষকাল দূরে

অমাবস্যা পাঁজর কাঁপিয়ে হাসে, বলে —

পিতৃ-পরিচয় দাও

যে-কোনও বেজন্মা শিশু সত্যকাম হয় না বালক!

 

আমাকে সবাই বলে — বলো সেই পুরুষের নাম,

কোথায় বসতি তার, দেশ বলো, নদী কিংবা গ্রাম;

বলে — জননীর কথা বলো, বলো কালপুরুষের কথা

শত-লক্ষ বছরের পরিযায়ী ক্ষত আর ব্যথা —

সেসব বৃতান্ত বলো শুনি;

স্বপ্ন পরিবৃত হয়ে আমি শুধু সংখ্যাতত্ত্ব গুনি।

আমি তো লুব্ধক মাত্র, পায়ের তলায় গুটিসুটি

একটু বেফাঁস হলে তরবারি দেখাবে ভ্রুকুটি।

 

ভ্রু-মধ্যে যে-তারা ফোটে শেষ রাত্রে, আজ,

দপ করে জ্বলে উঠল মধ্যদিনে যেন কোন

দিব্য সরতাজ; মাথায় আগুনবর্ণ রাংতার মুকুট;

আমি তাকে পিতা বলে ডাকি, ভাবি তার দেহগন্ধে

সারাক্ষণ থাকি। প্রশ্রয়ও পেয়ে যাই অযাচিত

ভিক্ষার মতন।

মাঠের রোদ্দুর থেকে গাছের ছায়ার কাছে ফিরি

দুই হাতে উপচে পড়ছে বিবিধ রতন — এ আমার আবাল্যের

স্বপ্ন ফেরি করে পাওয়া ধন।

 

লুব্ধক হব না আর পিতা

আমি কারও সত্যকাম নই।🚫


কবি উৎপল ত্রিবেদী

জন্ম: ২৮ আগস্ট, ১৯৫২ জন্মস্থান:কাঁচরাপাড়া। ১৯৬৪ সালে ইছাপুরে চলে আসা। উচ্চতর শিক্ষা:কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়:অর্থনীতি। কবিতা লেখার শুরু ১৯৬৮ সাল। কবি বলেন, "কবিতা বলতে যা বুঝি সে লেখার শুরু ১৯৭০ শেষ থেকে।" কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতার ভূমিকা প্রধান থেকেছে বরাবর। একই কারনে তিন দশক যাবৎ মফস্বল এবং কলকাতার বিভিন্ন দলের সাথে নাটকের কাজে যুক্ত থেকেছেন। কবিতা থেকে কিছুদিন সরে থাকতে হয়েছে ১৯৮২ র মাঝামাঝি থেকে প্রায় ১৯৯১ সাল অবধি। তারপর ক্রমশ ফিরে আসা এবং অদ্যাবধি কবিতা লেখা জারী আছে। এরমধ্যেই গদ্যচর্চার শুরু ২০০৪ সাল থেকে।

কাব্যগ্রন্থ
বন্দীগৃহ থেকে (কাব্যগ্রন্থ) ২০০৩
অর্ধেক মানুষ(উপন্যাস) ২০০৭
আত্মহত্যার অধিকার(কাব্যগ্রন্থ) ২০০৯
রাত্তির মানে তোর টেলিফোন (কাব্যগ্রন্থ) ২০১৭
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক (কাব্যগ্রন্থ) ২০১৮
মনখারাপের ঘর (গল্পগ্রন্থ) ২০১৯
স্বপ্নময় (কাব্যগ্রন্থ)  ২০১৯
The last glimps (অনুবাদ কাব্য) 2019
Its just winter ahead (ইংরাজী কবিতা গুচ্ছ) 2019 সাল।


অ থ বা

নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার) 
ক্লিক করে সেই লেখা পড়তে পারেন  

 
 
 








 
 
 
 
 
 

 
আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏