অতীতে বীরভূমের শিল্পচিত্র একটি পর্যালোচনা

শ্রীকান্ত অধিকারী

 (এক)

চাঙ্গা অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হল কৃষি ও শিল্প, পরে বাজার। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক দৃঢ় পরিকাঠামোর জন্য অনেকখানি দায়ভার বহন করে এই কৃষি ব্যবস্থাপাশাপাশি পূরক হিসেবে শক্ত কাঁধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিল্প। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন বর্তমান যুগে মানুষের ভোগপণ্যের প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ তার মূলে কিন্তু শিল্প। ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র কুটির শিল্প মাঝারি শিল্প বা বৃহৎ শিল্পও হতে পারেএই তত্ত্বের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের পাথুরে ও বন জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চল বীরভুম জেলার শিল্পায়ন চিত্রের দিখে ফিরে তাকানো যাক।

  জেলা বীরভূম বন সম্পদে খনিজ সম্পদে, কৃষজ সম্পদে পশ্চিমবঙ্গের অন্য জেলার থেকে পিছিয়ে নেই বরঞ্চ কিছু ক্ষেত্রে অনেক সমৃদ্ধশালী। তবুও এখনও পর্যন্ত সেভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারি উদ্যোগে শিল্পায়ন গড়ে ওঠে নি যদিও এলাকার স্বার্থে, জেলার স্বার্থে, রাজ্য তথা দেশের স্বার্থে এই উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিংবা যা গড়ে উঠেছিল তার সুরক্ষা

 ১৮৫৫ সালে রেভিনিউ সার্ভেয়ার Mr Sherwill সাহেবের রিপোর্ট অনুযায়ী বীরভূমের আয়তন ছিল ৩১৪২ বর্গমাইল। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ১১০ মাইল,প্রস্থে পূর্ব্বাংশে ৪০ মাইল এবং পশ্চিমাংশে ৩০ মাইল এই ভূখন্ডে সমস্ত জায়গা মনুষ্য বসবাসযোগ্য ছিল নাপৃথক পৃথক অংশে বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে বিভিন্ন আদিবাসী জাতি-উপজাতির মানুষেরা বসবাস করত। তবে বীরভূমের পশ্চিমাংশে সাঁওতাল পরগনা তথা বর্তমানে ঝাড়খন্ডের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ও বিহারসংলগ্ন বেশ কিছু অংশ ফাঁকা ডাঙা ডহরে পূর্ণ ছিলসেখানে না হত চাষ না ছিল সেরকম কোনও শাল মহুয়া বা মোল-সেগুনের জঙ্গল। তবে কোথাও কোথাও বহেরা, হরিতকি, বকুল বা বোল গাছ ছিল। ছিল প্রচুর খেজুরবন, মাঝে মাঝে তালের সারি। আর ছিল বাঁশ বন-কোঙা-কিছু ক্যাকটাস জাতীয় বুনো ঝোঁপালো ছোটো ছোটো গাছ। শোনা যায় ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৭৭০ সালে) বাংলায় সেই ভয়ঙ্কর মন্বন্তরের পরে এই স্থান, এই উঁচু-নিচু জমি এতটাই ঝোপ-ঝাড়জঙ্গলে ভরে উঠেছিল যে, সেখানে দিনেও বাঘ-ভালুক-হায়না-শেয়ালের মত শ্বাপদ ঘুরে বেড়াত। কে জানত সেই অনুর্ব্বর পরিত্যক্ত বনভূমি এবং ডহর যা ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ বিশেষ একদিন স্বর্ণগর্ভা রূপে আবিস্কৃত হবে। পরিণত হবে ভারী শিল্পের আকরস্থলে সমগ্র ভারতবর্ষে এই জেলা শিল্পাঞ্চল রুপে আখ্যায়িত হবে ।

       ২০১০-১১ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বীরভুম জেলায় প্রায় ৩৫.৭৫% মানুষের অবস্থান দারিদ্রসীমার নিচে যা পশ্চিমবঙ্গের অনান্য জেলার তুলনায় অনেকটা কম। অর্থাৎ এই জেলার মানুষেরা পেটের সংস্থান করা ছাড়াও আরও কিছু বেশি উপার্জন করে থাকেন তাতে তাদের জীবন ধারণের প্রাথমিক চাহিদাগুলো ছাড়াও সভ্য সমাজের নবতম সংযোজনগুলোও পাওয়ার চাহিদা দাবি করেনএখানে স্মরণযোগ্য যে কার্যকরী  চাহিদার কথাই বলা হল । কেননা চাহিদা পূরণ করার ক্ষমতা না থাকলে সেই চাহিদাকে কার্যকরী চাহিদা বলব না সেই দিক থেকে প্রাচীন বীরভূমের সামগ্রিক বিচারে শিল্পবহুল জেলাগুলো যেমন কলকাতা, বর্ধমান, হাওড়া, মেদনীপুর, হুগলি, দুই চব্বিশ পরগনা দার্জিলিং-এর তুলনায় পিছিয়ে ছিল না

       শিল্প মূলত দুরকমের — এক) কৃষিজাত দ্রব্য নির্ভর। দুই)অকৃষিজাত তথা খনিজ দ্রব্য নির্ভর। 

       এছাড়া অন্যান্য দ্রব্য নির্ভর, যেমন — পশুমাংসজাত বা পশুলোমজাত। পুকুর দীঘি নদী বা ভেরি ও খালে মাছ চাষের মত কিছু উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে শিল্প গড়ে ওঠে। গরু ছাগল ভেঁড়া শূকর ইত্যাদি গবাদি পশুপালন, হাঁসমুরগি পালনও এই ধরনের শিল্পের মধ্যে পড়ে। তবে এগুলো সব বর্তমান অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্হায় গড়ে ওঠা কিছু ক্ষুদ্র শিল্প বা ঘরোয়া শিল্পের অন্তর্ভূক্ত। যদিও বীরভূম তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীন চালচিত্রও বটেযা বহুকাল আগে থেকেই গ্রামের মানুষেরা নিজ নিজ পদ্ধতিতে আবাদ করত। তবে সে রকম ভাবে পরিকল্পিত রুপায়নে বা সুনির্দিষ্ট লভ্যাংশের লক্ষে এগুলো করত না।   

       এই প্রসঙ্গে বাংলার কুটির শিল্পের কথায় আসা যাক। একদা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৪% জমি জঙ্গলাবৃত ছিলছিল বেত বাঁশগাছের জঙ্গলএই বাঁশ গাছ লম্বা, সরু ফাঁপালো অথচ নমনীয় শক্ত বা দড় জাতীয়তাই এর গ্রাম্য ব্যবহার অতি মাত্রায় ছিল। এর কারণ অবশ্য মাটির বাড়ি ঘর।  এছাড়া বেত বা বাঁশের তৈরি পেছে ঝুরি ধামা কুলো পাখা খাঁচা খাড়ুই পলুই লাটাই ঘুরি জাফরি বাতার বেড়া খরের চাল বা ছাউনিতেও এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানে মাচা ও প্যান্ডেল তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়এমনকি বাঁশের সরু ঝোঁপালো ডাল বা কঞ্চির সঙ্গে কাদামাটি লেপে মাটির বাড়ির দেয়ালও তৈরি হত। এই সমস্ত বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র সাধারণত বীরভূমের ডোম জাতির মহিলা পুরুষেরাই করত। তবে কিছু কিছু ধাঙড় মাঝিরাও এই কাজে হাত লাগাত। 

        এখন লুপ্তপ্রায় পাকা মাটির জিনিসপত্র — কুঁজো কলসী হাঁড়ি হোলা,ভাঁড় কড়াই জালা জেলো সরা গেলাস বাটি কপ্টে বা চায়ের ভাঁড়। এমনকি গবাদি পশুদের খাওয়ানোর জন্য গৃহে দোনা অর্থাৎ বড় পাত্রের ব্যবহার ছিলবেশ কিছুদিন আগে পর্যন্তও শুগুনপুর, ভেজেনা, বজরপুর, বেলেরা, বসন্তপুর, আমাইপুর, কচুজোড়, জিউই, দৌড়ে, রাতগড়া, লাঙ্গুলে প্রভৃতি গ্রামের মানুষেরা মাটির জিনিসপত্র বানাতো। গ্রামের মানুষেরা তাদের বিবাহ শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে মাটির পাত্রে জল ডাল বা মাছ মাংসের ঝোলও দিত। পরবর্তীতে অত্যাধুনিক ভোগ্য পন্যের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় সেই সব মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার কমতে থাকল এবং বর্তমানে চা পানের ক্ষেত্রে কিছুটা বেঁচেবর্তে থাকলেও বাকি সব আধুনিক প্রজন্মের কাছে তা রূপকথার গল্প মনে হয় ।

       এ প্রসঙ্গে বনজ সম্পদের ব্যবহারেও কিছু ঘরোয়া শিল্পের নিদর্শনের কথা জানা যায়বীরভূমের পশ্চিমাঞ্চল তথা বর্তমান বিহার-ঝাড়খন্ড লাগোয়া যে বনভূমি রয়েছেচরিচা চন্দ্রপুর দ্বারবাসিনীগনপুর কিংবা ইলামবাজার বা খোয়াইয়ের ধারে কোপাই নদীর তীরে যে বিস্তৃর্ণ বনভূমি ঘিরে বীর‍ভূমকে ঘিরে রয়েছে(২০১০-১১ সনের সমীক্ষা অনুসারে সব মিলে বর্তমানে বনভূমির পরিমান ১৫৯২৬.৪১ হেক্টর) তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিপুত্রদের জীবন যাপনে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেযার ফলে বন সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী অতি প্রান্তবাসী মানুষেরা বা আদিবাসীরা বিশেষ করে সাঁওতালকোড়াহোধাঙড় শ্রেণির মানুষের জীবিকার মূলে বনজ সম্পদবনের কাঠ বা গাছ দিয়ে তৈরি আসবাব বা জ্বালানি, বিড়ি পাতা বা কেন্দ পাতারও চাহিদা প্রচুর পরিমানে ছিল। শালগাছের পাতা দিয়ে খাওয়ার থালা বাটি বর্তমানে চাহিদা রয়েছেকোনও কোনও জায়গায় মধুও পাওয়া যেত। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় আধুনিক থার্মকল বা প্লাসটিকের কাছে কতখানি সে অস্তিত্বের লড়াই করতে সক্ষম হবে! বীরভূমের কুঁচিকাঠি, শর বা খাগড়া গাছের ঝাঁট, জলজ এলাকায় মাদুর কাঠিরও একসময় গ্রাম বাংলায় ব্যাপক চাহিদা ছিল ।

       রামপুরহাটের চামড়া গুদাম ও নলহাটির চামড়া সংস্কারের কারখানা বীর‍ভূম প্রসিদ্ধ। এখানে গৃহপালিত পশু ও বন্য জীবজন্ত্তর চামড়া তথা সাপ কুমীর জাতীয় সরীসৃপের চামড়া সঞ্চয় ও ব্যবহারযোগ্য করা হতো। তাছাড়া বীরভূমের স্হানীয় মুচিরা ঢাক ঢোল মৃদঙ্গ খোল ডুগি তবলা নহবৎ ইত্যাদি তৈরি করতএখনও অবশ্য কোথাও কোথাও বানানো হয়ে থাকেতবে চামড়ার বদলে এখন এক ধরনের পলিমার জাতীয় উপাদান দিয়েও ঐসব বাদ্যযন্ত্র বানানো হচ্ছে। সিউড়ি সংলগ্ন আবদারপুরে চামড়ার কারখানা, শান্তিনিকেতনের আমার কুটীর ইত্যাদি জায়গার স্হানীয় শিল্পীদের তৈরি চামড়াজাত দ্রব্যাদির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে ।

       বীরভূমের রাজনগরে উৎপন্ন মোরব্বা উৎকৃষ্ট ও উপাদেয় মিষ্টান্নবর্গীয় দ্রব্যের খ্যাতি দেশ দেশান্তরে ছিল। ইংরেজ এসে রাজনগরের পরিবর্তে সিউড়িতে বীরভূমের রাজধানী স্হানান্তরিত করলে ঐ অঞ্চলের মোদকেরা  সিউড়ি এসে বেশ ভালো রকম মিষ্টান্নের সঙ্গে মোরব্বা সংযোজন করেনকিন্তু দূর্ভাগ্য এখনও পর্যন্ত বীরভূমের নিজস্ব এবং মৌলিক পদ্ধতিতে বানানো এই মোরব্বার পেটেন্ট নেওয়া হয়ে ওঠে নি

       এ ছাড়া অন্য এক ধরনের মিষ্টি বালুসাইও বঙ্গবিখ্যাত ছিল। গৌরহরি মিত্র মশায় বলেছেন, এই বালুসাইএর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে পর্যন্ত কেহই সামর্থ্য হয় নাই।

       একসময় দুবরাজপুরের হালকা ওজনের বেশ বড় আকারের বাতাসা উল্লেখ করার মত ছিল। জেলা সহ আশপাশ রাজ্যেও এর সুনাম ছিল।                                    

       লক্ষ্মীপুর বর্তমানে লোকপুরে কাঁচা পিতলের কারুকার্য করা কাঠের নির্মিত সেরপাই বাংলা বিখ্যাত ছিল। শিল্পী কমলাকান্ত কর্মকার এই পাই শিল্পে বিখ্যাত হয়ে ছিলেন। বর্তমানে কর্মকারেরা পিতলের সঙ্গে খাদ মিশিয়ে সের পাই পোয়া তৈরি করলেও সেই সেরপাইয়ের চাহিদা ও ব্যবহার একেবারে নেই বললেই চলেতবে এই সব সেরপাই এখন শৌখিন মানুষের ড্রয়িংরুমের শোভা বর্ধন করে থাকে।

সেরপাই। ছবি - লেখক।

সেরপাই। ছবি - লেখক।
       নলহাটি, দুবরাজপুর, হজরতপুর, হাজরাপুরে কাঁসা ও পিতল শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়তবে বীরভূমে কোথাও তামা উৎপাদন হত বলে জানা যায় নাতবে কাঁসা পিতল দিয়ে থালা বাসনপত্র জাতী কাঁচি ও ছুরি তৈরি হত বর্তমানে শুধুমাত্র কাঁসা পিতলের বাটি তৈরি হয় দুবরাজপুর, নলহাটি, সাঁইথিয়াতে। আর পুরোনোকে ঘসা-মাজা করে নতুন করা হয়ে শুধু।

       খরুনের লোহার সিন্দুক ও খড়গ; টেকরবেথর গাড়ু ইত্যাদি দেশজোড়া নাম ছিলদুবরাজপুরের কাছে শঙ্করপুরে জলসেচনের জন্য দুনী একসময় বীরভূমের চাষীদের ঘরে ঘরে থাকত মহম্মদবাজারের  তেঁতুলিয়া রানিপুর রাওতাড়া, সাঁইথিয়া, রাজনগর ও খয়রাসোলের কিছু কিছু গ্রামের স্হানীয় ডোম কর্মকার ও মুসলিম শিল্পীদের তৈরি শক্ত টিনের বা পাতলা লোহার পাতের চালধোওয়া টোকা ও চালুনির চাহিদা ছিল। সেই টোকা ও চালুনির গায়ে সুন্দর সুন্দর কারুকার্য করা থাকত। ক্রমে এইসব দ্রব্যাদির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়

        বীরভূমের মালাকার শ্রেণীর সুখ্যাতি ভারত বিখ্যাত এই মালাকারেরা শোলার সূক্ষ্ম কাজকে শিল্পের অতি উচ্চ স্তরে পৌঁছে দেনদেবদেবীর পূজার্চ্চনায় ডাকের কাজ, কদম ফুল, চাঁদমালা, টোপর ছাড়াও বর্তমানে ঐ মালাকার নির্মিত শৌখিন দ্রব্যাদির চাহিদা রয়েছে বীরভূমের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত শোলা শিল্পী শ্রী অনন্ত মালাকার এই শোলা শিল্পের এক স্বনামধন্য নামসরকারী বা বেসরকারী ভাবে আর্থিক সাহায্য না পেলেও সিউড়ি, রাজনগর, বোলপুর, দুবরাজপুর সুরুল, মুলুক, বাবুইজোড় রামপুরহাট, নানুর ,লাভপুর, কীর্ণাহার প্রভৃতি অঞ্চলে শোলা শিল্পীরা নিজ নিজ প্রচেষ্টায় শোলা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। 

শোলা শিল্পী শ্রী অনন্ত মালাকার
ভারত সরকার ২০০৪ সালে তাকে শিল্পগুরু আখ্যা দিয়েছেন। দিল্লি ন্যাশনাল মিউজিয়াম। ন্যাশনাল ক্রাফট্‌ মিউজিয়াম, ছত্রপতি শিবাজী মিউজিয়াম , মহারাষ্ট্রের এশিয়া প্লাটো পাঞ্চগনি , কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম , নেহেরু চিল্ডেন মিউজিয়াম, বিড়লা একাডেমী সহ বিভিন্ন জায়গায় তার শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন সময় তার শিল্পকর্ম পাড়ি দিয়েছে নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, টরেন্টো ওয়াশিংটন, জার্মানী, মস্কো, মরিশাস সহ বিভিন্ন বিদেশী মিউজিয়াম কিম্বা প্রদর্শনীতে। লিখেছেন তিন শতাধিক কবিতা, পঞ্চাশটি গল্প এবং প্রবন্ধ।রাজ্যের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার লেখা। প্রকাশিত হয়েছে তিনটি উপন্যাসও।দুই বাংলার শোলাশিল্প নিয়ে লিখছেন একটি বই।


শোলা শিল্পী দেবপ্রসাদ কাহারের একটি শিল্পকর্ম।
সিউড়ি সবুজের প্রাঙ্গণ-ভবনে প্রদর্শনীর সময় (১৩-১৫ ডিসেম্বর ২০১৯) সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার তোলা ছবি।
সম্প্রতি শিল্পী করোনায় প্রয়াত হয়েছেন। তার প্রতি আমাদের রইল শ্রদ্ধার্ঘ।
  

 

প্রসাদ কাহারের আরেকটি শোলা শিল্পকর্ম
প্রদর্শনীর সময় সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার তোলা ছবি।

রসা, দুবরাজপুর, তারাপুর, ডাবুক, কলেশ্বর, ভান্ডীরবন, জয়দেব, চিনপাই, কুলিয়া, রাইপুর ইত্যাদি নানান জায়গায় সুবৃহৎ দেবমন্দির এখনও কিছু কিছু নিদর্শন রয়েছেতাতে পোড়ামাটির কিংবা কাঠের কারুকাজ বা কাঠ খোদাই করা বিভিন্ন পৌরানিক চিত্র প্রমাণ করে এই স্হাপত্যশিল্পের  বহমানতা ও সর্বজনগ্রাহ্যতা। একই সঙ্গে পাঠান ফৌজদারগনের তৈরি প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু গৃহাদি ও মসজিদ তোষাখানাতে দক্ষ মুসলমান শিল্পীসত্তারও পরিচয় ঘটে। এ বিষয়ে রাজনগরের মতিচূড়া মসজিদ উল্লেখযোগ্য ।

       বর্তমানে মানুষের প্রয়োজনহীনতার সঙ্গে সঙ্গে একদা সুখ্যাতি অর্জন করা বহুল পরিমানে উৎপাদিত এই সব দ্রব্যাদি আজ অবলুপ্তির পথে এখানে উল্লিখিত প্রায় অনেক ঘরোয়া শিল্প যা বড় আকারে কুটীরশিল্পের মর্যাদা পেতে পারত তা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছেহয়তো সেভাবে পরবর্তী প্রজন্ম ঐ সমস্ত কাজ করার তাগিদ এবং গুরুত্ব অনুভব করেনি কিংবা সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গ্রাম ও শহরের কাজকর্মের ও উপার্জনের ভিন্ন ভিন্ন পন্থা ঐ সব কাজ থেকে বিমুখী করেছে। পুরাতন ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের কাছে আজ ব্রাত্যই হয়ে আছে ।

(দুই)

১৯১০-১১ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী  বীরভূমের শিল্পের বাস্তব চিত্রটি হল ক্ষুদ্র শিল্প: ১০১৭২টি, মাঝারি শিল্প: ১১৫টি, খাদি সংস্হা: ৩৪টি, ভারি শিল্প: ১টি (বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র) এই তথ্য একটি উন্নয়নশীল রাজ্যের অর্থনৈতিক স্তম্ভ হিসেবে অত্যন্ত দূর্বল মনে হলেও আপাত আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে গত অর্ধশতকের শিল্পায়ণের গ্রাফচিত্র পর্যবেক্ষণের বিচারে কম নয় অথচ এই অবস্হা হওয়ার কথা ছিল নাঅন্তত বীর‍ভূম জেলার অতীত শিল্পের আশাব্যঞ্জক ইতিহাস সমীক্ষা করলে বীরভূমবাসীদের গর্ব হওয়ার কথা

বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।। ছবি- WPBDCL 
       কোন শিল্প গড়ে ওঠে নি! গালা ,চিনি,তসর শিল্প, রেশম শিল্প খড়ি মাটি-লাল মাটি কাঁকর মাটি, লোহা পাথর ইত্যাদি নানান শিল্প গড়ে ওঠে এই বীরভূমের মাটিতে। 

       অর্থনীতির ব্যাখ্যায় বলা হয় যে, কোনও স্হানে শিল্প গড়ে ওঠার প্রধান কারণ হল ঐ এলাকার যথেচ্ছ কাঁচা মালের জোগান, সুলভ ও দক্ষ শ্রমিকের জোগান, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্হা এবং উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারে চাহিদা এই সব মিলে কোনো অঞ্চলে শিল্প গড়ে ওঠে। এক সময় বীরভূম সেই সমস্ত শর্তগুলো মেটাতে সক্ষম ছিল ।

কৃষিজ শিল্পগুলির সবগুলিই মাঝারি শিল্পের মধ্যে পড়েবীরভূমে প্রথম বিদেশীরা আসে যার লোভে তা হল লাক্ষা লাক্ষা থেকে রং, শৌখিন শিল্পদ্রব্য, পুতুল মালা চুড়ি নানান জীবজন্তু ফল খেলনা ইত্যাদি তৈরি হত, যার বাজার চাহিদাও বেশ ছিল। ইলামবাজারে গালা নির্মিত পুতুল, গালার চুড়ি বিখ্যাত ছিল ততদিনে  বোলপুর থেকে ৯/১০ কিলোমিটার দূরে সুরুল ও দ্বারান্দা অঞ্চলে প্রায় প্রতি গ্রামেই লাক্ষা চাষ হত। ঐ লাক্ষা থেকে দেশীয় পদ্ধতিতে গালা তৈরিও হত। পরে ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দে ঐ ছোট ছোট ঘরোয়া কারখানাগুলি একত্র করেন ‘Erskine and Co.’ কোম্পানি। এই কোম্পানি প্রায় পঁচাশি ছিয়াশি বছর ধরে ব্যবসা চালায়। পরে আস্কাইনের দুই সন্তান ও দুই ভ্রাতুষ্পুত্রের মৃত্যুতে আস্কাইনের নাতি(কন্যার পুত্র) ফারকুহারসন এবং ক্যাম্বেলের কোম্পানি গালা উৎপাদন শুরু করেনকিন্তু পারিবারিক ঔদাসিন্য, তিন সহকারীর সর্ব্বময় কর্তা হয়ে ওঠা, বিজ্ঞানের সাহায্যে রঙের উৎপাদন, গালার ব্যবহার কমে যাওয়া, কোম্পানির ঋণজালে জড়িয়ে পড়া  এবং শেষমেষ ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে না ওঠা ইত্যাদি নানান কারণে বীরভূমের লাক্ষা উৎপাদন তথা গালা শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হয়

       বাঙালীর ইতিহাস গ্রন্হে নীহাররঞ্জন রায় বাংলাদেশের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে চিনির উল্লেখ করেনসেই অর্থে এই জেলা পিছিয়ে ছিল নাবীরভূমে মোট ৪৫টি চিনি উৎপাদন কেন্দ্র ছিল খটঙ্গায় ২টি, বড়রায় ১২টি, শাহ-আলমপুর পরগনায় ৩০টি, জয়নুজল পরগনায় ১টি ছিল।

দুবরাজপুর থানার কুখুটিয়া গ্রামে ঈষৎ লালাভ চিনি উৎপাদিত হত। এই চিনি দেবভোগ্য বলে বিবেচিত হত। পরিশেষে বীরভূমের শেষ চিনির কারখানার একমাত্র প্রতিনিধি করত আহমদপুরের চিনির কারখানা। কিন্তু সেটিও বিভিন্ন কারণে সরকারি টালবাহানা ও লাভ না হওয়ার অজুহাতে প্রায় দুদশক হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বীরভূমে সেরকম মাঝারি শিল্প প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ।

আহমদপুরের চিনির কারখানার গেট, বর্তমানে নিশ্চিহ্ন
ছবি সংগ্রহ - লেখক

আহমদপুরের চিনির কারখানার গুদাম, বর্তমানে নিশ্চিহ্ন
ছবি সংগ্রহ - লেখক

এই জেলায় এখনও পর্যন্ত টিম টিম করে তসর শিল্প বেঁচে আছ কড়িধ্যা তাঁতিপাড়ার কিছু অংশে তসর চাষ দেখা যায় সিউড়ির কাছে তসরকাটা নাম থেকেই এই এলাকার কার্যবিষয় বোঝা যায়।  এছাড়াও রামপুরহাটের কাছে পাঁচগাছিয়া ও দাভপুরে তসর চাষ করা হয়মহম্মদবাজার সংলগ্ন নির্ভয়পুরে হাইওয়ের ধারে বেশ কয়েক বছর ধরে তসর কীটের চাষ করা হয় পূর্বে সাঁওতাল, কোল, হো, ধাঙড়েরা বনভূমি থেকে তসর গুটি সংগ্রহ করত এবং সেগুলি আঞ্চলিক ব্যবসাদারদের কাছে বিক্রি করত। তসরজাত সুতো শুদ্ধ। এটি খাঁটি খদ্দর পূজার্চ্চনায়, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে দোলদুর্গোৎসবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেবীরভূমের লিপিকরেরা জানাচ্ছেন পূর্বে বীর‍ভূম হতে কোটের উপযোগী তসর থান ইউরোপে ও অষ্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি হত

       শোনা যায় শুধুমাত্র রেশমের টানে ইংররেজরা এই জেলায় প্রথম আসেনসর্বপ্রথম জন চীপ সাহেব সুরুল গ্রামে আসেনসেই সময় সুরুল গ্রামে দৈনিক হাজারখানা দেশী হাতের তাঁত চলত পরে গুনুটিয়ায় কুঠী নির্মিত হয়

       ভদ্রপুর, মাড়গ্রাম, বসোয়া, বিষ্ণুপুর, পলসা, নোয়াদা, লোহাপুর, কোটাসুর, তারাপুর, মাধ্যার তেঁতুলিয়া, ভালকুটি, আবাডাঙা, দোয়ারকি, ভোলা গ্রামে ছোটাখাটো রেশম শিল্প গড়ে ওঠে। এছাড়া বীরভূমের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের মৌড়েশ্বর থানা হতে মুরারই থানার শেষ পর্য্যন্ত অধিকাংশ গ্রামেই রেশম গুটি ও তুঁত-পাতার চাষ প্রচলিত এখনও আছেএকসময় সমগ্র ভারতের মধ্যে শুধুমাত্র বীরভূমেই পাঁচ-ছয় হাজার মন রেশম প্রস্তুত হতবীরভূমের  ইতিহাস নথি দিচ্ছে যে ১৯১৩-১৪-১৫ সনে ৪৭৮৩০৩ টাকার রেশম বিদেশে রপ্তানি হয়েছিল।                              

       রাজনগর এলাকায় সিসাল উদ্ভিদ Sisal sp. থেকেও সুতো এবং নানান মোটা কাপড়, সুদৃশ্য চাদর বা বিছানার চাদর ইত্যাদি তৈরি করে থাকেন এখনও

সিসাল উদ্ভিদ ও তার অর্থনৈতিক ভূমিকা নিয়ে একটি প্রবন্ধের অংশ

       খনিজ শিল্প

       ছোটনাগপুরের কিছু অংশ বীরভূমের পশ্চিম অংশে পড়ায় এই এলাকাগুলি পুরোটাই বনভূমি, পাথর ও কাঁকড়পুর্ণ অনুর্বর মৃত্তিকা শ্রেণিতাই আপাত ঢিবি ও ডাঙা ছোট ছোট পাহাড় জাতীয় মনে হলেও এই ভূমিগর্ভে লোহা কয়লা অভ্র খড়িমাটি লালমাটি কাঁকড় ঘুটিং ইত্যাদি অতি মূল্যবান সব খনিজ বস্তুর সন্ধান মেলে। তাই হয়তো একদিন এই জেলায় মাঝারি থেকে ভারি শিল্প গড়ে উঠেছিল ।

    জিওলজিক্যাল সার্ভে ওব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে ১৮৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে জানা যায় বীর‍ভূমে প্রধান লোহা উৎপাদন কেন্দ্র ও লোহা গলান কাজ হত রামপুরহাটের কাছে  বেলিয়া, নারায়নপুর ডেউচা  গণপুর  এই পাঁচটি গ্রামে এই গ্রামগুলিতে ৭০টি চুল্লি ছিল। এছাড়া ডামরা ভারকাটা  কানমুড়া, মল্লারপুরের কাছে হাটগাছিয়া গ্রামে লোহা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিলটাঙ্গশুলি, ডেউচা, মহম্মদবাজার, লোহাবাজার গ্রামে এখনও লোহা-পাথরের বহু স্তর ও ব্যবহৃত অপরিশুদ্ধ লোহার আকর দেখতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলগুলোকে একসঙ্গে লোহামহল বলা হত

       কিছুদিন আগে পর্যন্ত মহম্মদবাজার বাসস্ট্যান্ড তথা স্টেট ব্যাঙ্কের কাছাকাছি হাইরোডের পূর্ব-পশ্চিমে দুটি চুল্লি বীরভূমে লৌহ শিল্পের ধ্বজা তুলে দাঁড়িয়েছিল NH 60 তৈরির সময় একটি ভাঙা পড়ে।

এই সময় ভারতের অন্যান্য জায়গার তুলনায় বীর‍ভূমে চুল্লির সংখ্যা অনেক বেশি ছিলশুধুমাত্র ডেউচা গ্রামেই তিরিশটি চুল্লি ছিল। শোনা যায় এই সব উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ২৩৮০টন অপরিষ্কৃত লোহা আর ৪৫০০০ মন পাকা লোহা উৎপাদিত হত

        কলকাতার ম্যাকে কোম্পানি ১৮৫৫ সালে ‘Birbhum Iron works Company’ নামে লোহামহলে এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার বিঘা জমি ইজারা নেয় এবং মহম্মদবাজারে লোহার কারখানা স্হাপন করেবর্তমানে সেই স্হানের নাম লোহাবাজারই আছে এখান থেকে প্রত্যেক দিন দুই টন করে কাঁচা লোহা উৎপাদন করা হতকিন্তু এই কারখানা খুব একটা লাভের মুখ দেখে নিতাই মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যেত

       ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দের পর মেসার্স বার্ণ অ্যান্ড কোম্পানি বিদেশি পদ্ধতিতে এই কারখানার হাল ধরলেও অবস্থা খারাপ হতে হতে বছর দুয়েকের মধ্যেই কারখানা প্রভূত লোকসানের মুখে পড়ে এবং শেষবারের মত বীরভূমে লোহার কারখানা করার ইচ্ছা সমূলে বিনাশ হয় তবে বীরভূমের এই শিল্পের পতনের জন্য অবশ্য প্রযুক্তিগত ত্রুটি, স্হানীয় জমিদারের আর্থিক শোষণ, জ্বালানির অভাব এবং সর্বোপরি আকরিক লোহার সহজলভ্যতার অভাবকেও দায়ী করা হয়ে থাকে

       বর্তমানে পাথর শিল্প বীরভূমের অন্যতম শিল্প পাঁচামি অঞ্চলে বিশেষ করে ভাঁড়কাটা হরিণশিঙা, শালবাদরা, তেঁতুলবাঁধি, ঢোলকাটা, দেওয়ানগঞ্জ, কলকলি, হাবরাপাহাড়িতে বড় বড় খাদান কেটে গ্রানাইট পাথর উত্তোলিত হয় তবে এই শিল্পেরও শুরু ওই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ফারকুহারসন ও ক্যাম্বেল সাহেব এই পাথর শিল্পের চিন্তা ভাবনা করেনশোনা যায় রামপুরহাট মহকুমায় মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এই পাথরের কারবারে এসেছিলেন

Bengal District GAzetteers: Birbhum
L.S.S. O'Malley 1910
       একদা রাণীগঞ্জ কোলফিল্ড বীরভূমের অন্তর্ভূক্ত ছিল এছাড়া অজয় তীরবর্তী আরং এবং বড়জোড়েও কয়লা উত্তোলন হততবে একই সময়ে লোহা পাথর কয়লা এই তিন খনিজ সম্পদের খবর ইংরেজরা পেয়েছিলেনডেউচা — পাঁচামিতে যে কয়লা খনির খবর পাওয়া যায় তাতে বিশাল এলাকা জুড়ে কয়লার স্তর রয়েছে — প্রায় ৫ বিলিয়ন টন। এরিয়া-৯.৭ বর্গ কিমি। অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। বীর‍ভূম কোল কোম্পানি লিমিটেড এর সুত্রে জানা যায় এই অঞ্চলের কোল ব্লকের রিপোর্ট অনুসারে এটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ কোল ব্লক এরিয়াতবু এইমুহূর্তে ঐ এলাকায় কোলিয়ারি খোলার সরকারি কোনও সদিচ্ছা জানা যায় নি কিন্তু চোরাপথে চোরাকারবারিরা বহুদিন থেকেই এই কয়লা চুরি করে সাইকেলে করে বা ভটভটি করে বিভিন্ন গ্রামে কিংবা ইঁটের ভাটায় ভাটায় বিক্রি করছে                           

মহম্মদবাজার থানার প্যাটেলনগর খড়িয়া গ্রামে মা মিনারেল ইন্ডাস্ট্রি সহ মকদুমনগর, কোমরপুর, আঙ্গারগড়িয়া, মহম্মদবাজার এলাকায় খড়িমাটি উত্তোলন সহ পরিশুদ্ধ ও প্রক্রিয়াকরণ এখনও চলছেতাতে আশপাশ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ কর্মরত। স্হানীয় লোকেদের কাছে খড়িমাটি মানেই ঘোষ কোম্পানি জানেএছাড়া সিঙ্গুর খয়রাশোল থানার বড়রা গ্রামে খড়িমাটির নিদর্শন পাওয়া যায় খড়িমাটি পেপার, রাবার, রঙ, সেরামিক শিল্পে প্রচুর পরিমানে চাহিদা রয়েছে।

       খড়িমাটি  সহজলভ্য হওয়ায় প্যাটেলনগর — আঙ্গার গড়িয়ার ফাঁকা মাঠে চিনামাটির  কারখানা একদা রমরমিয়ে চলত। এখান থেকে চিনামাটির থালা, কাপ, ডিস, ঘর সাজানো দ্রব্যাদি তৈরি হত তবে বিশেষ ভাবে ইলেকট্রিক সংক্রান্ত অর্থাৎ চাকা, চারদিক ছিদ্রযুক্ত ছোট ছোট চিনামাটির দ্রব্য প্রস্ত্তত হতবেশ কয়েকবছর হয়ে গেছে এই কারখানাটি বন্ধ তবু পাঠ্য বইয়ে এর পরিচয় স্থায়ী হয়ে আছেবর্তমানে এটি একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে

       প্রসঙ্গক্রমে আর কিছু অনুষঙ্গ শিল্পের উল্লেখ করা যেতেই পারেলাল মাটির দেশ এই বীর‍ভূমে তুলনামূলক ভাবে লালমাটির ব্যবহার কমই দেখা গেছেতবে ইদানিং মহম্মদবাজার এলাকায় লালমাটির রঙ তেরি হচ্ছে কোথাও কোথাও একে অ্যালা মাটিও বলা হয়এর ব্যবহার বিভিন্ন রঙে, বাড়িতে, বড় বড় দেয়ালে রঙ করতে এবং অবশ্যই এখন আলু ইত্যাদি কাঁচা সবজিতে এর বহুল ব্যবহার দেখা যাচ্ছে

       একসময় চিনপাইয়ের বারুদ ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত বারুদের চাহিদা ছিল ভারতবর্ষের বাজারে। সেটিও শুধুমাত্র অবহেলায় কালের অতলে চলে যায়ইস্টার্ন এক্সপ্লোসিভ কেমিক্যালস লিমিটেড নামে চিনপাইয়ে ১২৩৬ একর জমিতে ১৯৮৩ খৃ: প্রতিষ্ঠা হয়। ঐ বছরেই উৎপাদন শুরু হয়১৯৯৬ খ্রি. কারখানাটি বন্ধও হয়ে যায়আজও সেই কারখানার ধ্বংসাবশেষ স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে

       পরিশেষে আর একপ্রকারের শিল্পের পরিচয় স্হানীয় লোকেরা জানেন। কখনও কখনও আড়ালে বা লুকিয়ে চললেও স্হানভেদে এর চাহিদা রয়েছ তবে এগুলি শিল্পের পর্যায়ে পড়ে কিনা সন্দেহের অবকাশ আছে। এগুলিকে বদশিল্প বা কুশিল্প বলাই বাঞ্ছনীয় যে শিল্প আপাত অর্থের জোগান দিলেও অদূর ভবিষ্যতে মানবকল্যানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে তাকে কখনই শিল্প হিসেবে দাবি করা যায় নাতবু কিছু কিছু উৎপাদন শিল্পের পর্যায়ে চলে যায় তবে অবশ্যই সেটা বদ শিল্পযেমন তামাকজাত শিল্প — বিড়ি, গুটকা, খৈনি, গালি ইত্যাদির বিশাল চাহিদার জন্য পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে এর ব্যবহার চলে আসে

বীর‍ভূমের গ্রামে গ্রামে এটি পচুই বা চোলাই বা চুল্লু নামে অধিক পরিচিত। বহু প্রাচীন কাল থেকেই এর ব্যবহার চলে আসছে দেশি মদ সরকার দ্বারা ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্ত একটি দ্রব্যএর থেকে সরকারি আবগারি দপ্তর প্রচুর আর্থিক লাভের মুখ দেখেমনে হয় বিশ্বে সবচেয়ে পুরাতন শিল্প হল চুল্লু শিল্প। এছাড়াও লঘু স্পিরিট জাতীয় একধরনের পানীয় তৈরি ও এখন হচ্ছেবর্তমানে সিউড়ি থেকে আহম্মদপুর যাওয়ার রাস্তায় একটি স্পিরিট কারখানা তৈরি হয়েছে

       প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে আর এক প্রকার বদ শিল্পের পরিচয় পাই। নদীমাতৃক পশ্চিমবঙ্গভূমিতে বীরভূমের মূল নদ-নদীর সংখ্যা ৬টি। আর কুলে নদী, শাল নদীর মত ছোট ছোট স্রোতস্বিনীও বীরভূমের মাটির ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। বর্তমানে এই নদীগর্ভ থেকে যথেচ্ছাচারে বালি উত্তোলন শুরু হয়েছে। বৃক্ষছেদনের মত বালি উত্তোলনের ফল যে কত মারাত্মক, সমাজ পরিবেশে বিশেষ করে বাস্ত্ততন্ত্রের ওপর আত্মহননের মত আত্মক্ষয়ী আঘাত হানতে পারে, তার তোয়াক্কা না করেই শয়ে শয়ে নদীর বুকে বেআইনি ভাবে বালিঘাট বানিয়ে ফেলছেতৈরি হচ্ছে সিন্ডিকেট।

       পরিশেষে বর্তমানে পর্যটন শিল্পের কথা না উল্লেখ করলে আমার বক্তব্যে খামতি থেকে যাবে। পাথর, বালি ও খড়ি মাটির পর বীরভূমের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হল পর্যটন শিল্পমূলত এই শিল্প দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু ধর্মীয় পীঠস্থানকে কেন্দ্র করে। বীরভূমে এমন কিছু পীঠস্থান রয়েছে তা শুধু বীরভূম বা পশ্চিমবঙ্গবাসীকেই টানে না, সারা ভারতবর্ষব্যাপী পুন্যার্থীর সঙ্গে বহু ধার্মিক ও প্রকৃতিপাঠে আগ্রহী ভ্রমণার্থীরা বা অজানাকে  জানার তাগিদে অনেকেই এই বীরভূমে চলে আসেন সরকারী সাহায্যের তোয়াক্কা না করে ধীরে ধীরে মানুষের সচেতনার কারণে বর্তমানে তারাপীঠ (তারা মা), বক্রেশ্বর (বক্রনাথ মহাদেব), লাভপুর (ফুল্লরা মা এবং সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), নলহাটি(নলাটেশ্বরী মা), জয়দেব(কবি জয়দেব ও বিখ্যাত কেঁদুলি- জয়দেবের মেলা), শান্তিনিকেতন, দুবরাজপুর পাহাড়েশ্বরের মত ঐতিহ্যমন্ডিতস্থানগুলো আজ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকায় পর্যটনশিল্পের উন্নতি ঘটছে। তবু এই স্থানগুলোর আরও সংগঠিত সমন্বয় দরকার আরও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংস্কার ও প্রচার প্রয়োজন।  🚫              

শ্রীকান্ত অধিকারী

শ্রীকান্ত অধিকারী। সিউড়ি বীরভূম। পেশায় শিক্ষক। মাষ্টার্স — বাংলা ভাষা এবং শিক্ষা। নেশা গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমন কাহিনী লেখা। প্রিয় শিশুতোষ চরিত্র সৃষ্টি — রাঙাপিসি। জ্বলদর্চি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে রাঙাপিসির গল্প নামে শিশুতোষ গল্পের সিরিজ প্রকাশ পাচ্ছে।

আদ্যন্ত গ্রামের মানুষ। তাই গল্পে বারবার গ্রামজীবনের সমস্যা তথা নানান কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, বর্তমান, তথ্যকেন্দ্র সহ নানা পত্র পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া দি ওয়াল, ইরাবতী, পারক, জ্বলদর্চি ইত্যাদি নানান ওয়েব ম্যাগাজিনেও লিখে চলেছেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ — হাঁসের পালক। প্রকাশক — সৃষ্টিসুখ পাবলিশার্স। ২০২০সাল ।


অ থ বা

নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার) 
ক্লিক করে সেই লেখা পড়তে পারেন  

 
 
 








 
 
 
 
 
 

 
আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏