- - - পা ঠ প্র তি ক্রি য়া - - - |
অণুগল্পমালা ১
সম্পাদনা - সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক - সৃষ্টিসুখ
প্রথম সংস্করণ জুন, ২০২৩
প্রচ্ছদ - রোকু
হার্ড বোর্ড বাইন্ডিং
ISBN 978-93-92500-88-6
মূল্য - ২২৫/- ভারতীয় মুদ্রা / ১৪.৯৯ আমেরিকান ডলার
৬০ জন গল্পকারের অণুগল্পগুলি লেখকদের নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী সূচীতে সাজানো
হলেও,
গল্পগুলি পড়ার পর আপনা হতেই বিভিন্ন বিভাগে তারা সারি বাঁধবে পাঠকের মনে। বইটির নাম ‘অণুগল্পমালা ১’। সম্পাদক
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজনৈতিক গল্পের সারিতে যে গল্পগুলি সেরা সেগুলি হল অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘স্মৃতি-সত্তা’, তৃষ্ণা বসাক-এর ‘বেহাত’, চিরঞ্জয় চক্রবর্তী-র ‘কল্পতরু’, ও মৌসুমী ঘোষ-এর ‘বিস্তার’। উল্লিখিত প্রতিটি গল্পই একইসঙ্গে রূপকাশ্রয়ী ও প্রতিবাদী।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে লেখক যখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে নিজস্ব বক্তব্যকে গল্পের ভাবনায় আশ্রয় দেন তখন সেই গল্প অবশ্যই দাগ
কাটে পাঠক মনে। অল্প কথায় গভীরভাবে পাঠকমনে এই দাগ রেখে যাওয়াটাই অণুগল্পগুলির উদ্দেশ্য। এগুলি ছাড়াও রূপম চট্টোপাধ্যায়ের ‘খাঁচা’ রাজনৈতিক মতাদর্শে
লেখা দেশভাগের সময়ের গল্প।
আধুনিক সমাজবদলের সংকট ধরা পড়েছে যে গল্পগুলির মধ্যে তার মধ্যে থেকে রাজীব
কুমার ঘোষের ‘যারা চায়ের দোকান হারিয়ে ফেলেছিল’ ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের ‘ম্যাচমেকার’ সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে লেখা গল্প।
এছাড়া এই সারিতে অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর ‘দিনেনের ফোন’, কাবেরী চক্রবর্তীর ‘কাচের শিশি
কাচের বোতল’, ঋতা বসুর ‘নেশা’, ঈশা দেব পালের ‘প্রেম’, রাজেশ কুমারের ‘জারিকেনে জল নেই’,
উল্লেখযোগ্য। এই গল্পগুলি বেশ ভয়ের
রেশ রেখে যায় পাঠক মনে। গল্পগুলি শেষে পাঠক-মন খুঁড়ে চলে স্মৃতির কবর। বর্তমান
সময়ের সংকটের কিনারে দাঁড়িয়ে লেখকেরা দেখিয়ে দেন ভবিষ্যতের বৃহৎ আশঙ্কাগুলিকে।
প্রেমের গল্পের সারিতে আছে, প্রচেত গুপ্তের ‘ভুলে গেলে?’, সিক্তা গোস্বামীর ‘ছাতা’, সন্দীপ রায়ের ‘আমার যা
কিছু বলার...’, নিয়তি রায়চৌধুরীর ‘উপক্রম’, নন্দিনী সেনগুপ্তের
‘কাঁচা লঙ্কা’, মানস সরকারের ‘ভাইরাল’। গল্পগুলি প্রেমে গদগদ একেবারেই নয়। তবে বিভিন্ন বয়সের
প্রেম মাত্রা অনুযায়ী প্রভাব ফেলেছে গল্পগুলিতে।
বিরহের গল্পের সারিতে আছে সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জানলায় পরি’, কৃষ্ণা রায়ের ‘পুরোনো
রোদ্দুর’,
ও অভিজিৎ চৌধুরীর ‘শ্বেত অশ্ব’। কেউ রূপকথা, কেউ ইতিহাস, কেউ কাব্যের আশ্রয় নিয়েছেন গল্পগুলি
লিখতে।
সামাজিক অবক্ষয়ের ধারা উঠে এসেছে যে গল্পগুলিতে তার মধ্যে পড়ে সুপ্রিয় চৌধুরীর
‘খাদ্য-খাদক’, বিজন রায়চৌধরীর ‘দৃষ্টি’, উজ্জ্বল রায়ের ‘ভয়’, অরিন্দম গোস্বামীর ‘ভৈরবী’, ইন্দ্রনীল বক্সীর ‘আঠাশ রিল’, মৃত্তিকা মাইতির ‘ফুটপাত ও
সেই বুড়িটা’, শ্রীকান্ত অধিকারীর ‘ছোট মুখ’, শুভশ্রী সাহার ‘কমরেড’, রাজা মুখোপাধ্যায়ের
‘ফোন অফ’, রজত চক্রবর্তীর ‘সহজ’, চন্দ্রানী বসুর ‘তিনটি বেড’, সুব্রত দেবের ‘আহ’। গল্পগুলি অনেকটা চোখে আঙুল দাদার কাজ সেরেছে। এই ধরনের
গল্প বহুল প্রচলিত হলেও খুবই মর্ম বিদারক। উল্লিখিত প্রতিটি গল্পই বিষয় অনুযায়ী ভাষা
প্রয়োগ করে লেখকেরা লিখেছেন, ফলে প্রতিটি
অণুগল্পই পাঠ শেষে তৃপ্তি দেয়।
সামাজিক সংস্কার নিয়ে লেখা গল্প নীতা রায়ের ‘খিদে’,
অরুণ দে’র ‘ভেতরের পোশাক’, সমীরণ রায়ের ‘ছেলেটা’, শ্যামলী আচার্যের ‘জলচৌকি’। গল্পগুলির প্রতিটির ভঙ্গীমা আলাদা তা বলাই বাহুল্য। এই গল্পগুলি
যথেষ্ট আশার আলো দেখায়, চিরকালীনতাকে ধরে
রাখার প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
ধর্মীয় অনুষঙ্গের সঙ্গে জড়িত গল্পগুলি হল
সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ‘ভুবনজোড়া নিরঞ্জনের
আলো’,
ও রামামৃত সিংহ মহাপাত্রের ‘মা’।
ষাট-টি অণুগল্প পাঠের পর বেশ কিছু গল্প ভাবিয়েছে
বই কী। তারমধ্যে অরিন্দম বসুর ‘পরবর্তী স্টেশন’, শতদ্রু মজুমদারের ‘প্রক্সি’ গল্পদুটি অনন্য। রম্যরসে জারিত প্রিয়ঙ্কর চক্রবর্তীর গল্প ‘সূর্যাস্তের
আগে’
বেশ উপভোগ্য, পূর্বা কুমারের গল্প ‘দেশ’ শিক্ষামূলক গল্প। উল্লিখিত গল্পগুলি ছাড়াও সাত্যকি হালদারের
‘চাবি’, শুভ রায়চৌধুরীর ‘রামকুমারের সুর’, ফাল্গুনী পান্ডার ‘নিখোঁজ’ রেশ রেখে যাওয়া গল্প। আর আমরা জানি এই রেশ রেখে যাওয়াই অণুগল্পের অন্যতম প্রধান
বৈশিষ্ট্য।
অণুগল্পগুলিকে সারিতে বিভাজন করতে গিয়ে দেখা গেল অধিকাংশ গল্পকারের গল্পে আধুনিক সমাজবদলের সংকটের ভয় আর সামাজিক
অবক্ষয়ের দলিল উঠে এসেছে। এসবই যদিও আলোচকের নিজস্ব ভাবনা। তবু বলতেই হয় গল্পকাররা
অনেকাংশে ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও। যদিও কেবলমাত্র একটি সংকলনের ওপর নির্ভর করে এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়, তবু সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ষাটজন এই সময়ের গল্পকারের কলমের
দিক নির্দেশ কম কীসে?
শেষপাতে অম্লের মতো বলতেই হয় মাত্র দু’চারটি গল্প
যত না অণুগল্প তার থেকেও বেশি ছোটোগল্পের বীজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, অণুগল্প ছোটোগল্পের ক্ষুদ্র সংস্করণ নয়। তাছাড়া দু‘একটি গল্পে লেখকরা যে
শৃঙ্গার রস বা রম্য রসের প্রবেশ ঘটিয়েছেন তা অনেকটাই মনে হয় প্লটে চমক রাখার
প্রচেষ্টা হেতু। ফলে
গল্পগুলির আবেদনে চুটকির ছায়া পড়েছে।
ষাটজন এই সময়ের বিশিষ্ট গল্পকারদের গল্প জড়ো করে এক মলাটে তুলে ধরার জন্য ও
পাঠকদের বেশ কয়েকটি ভালো গল্প
একসঙ্গে পাঠের সুযোগ করে দেবার জন্য সম্পাদককে সাধুবাদ জানাই।
দু -তিনটি বর্ণ বিচ্যুতি ছাড়া সম্পূর্ণতায় বইটি নিষ্কলঙ্ক। প্রকাশক সৃষ্টিসুখের তারিফ পাঠক ও ক্রেতা মাত্রই করবেন এর বাঁধাই, প্রচ্ছদ ও পাতার গুণ বিচারের ক্ষেত্রে। বইটির সাইজ খুবই আকর্ষণীয়। সব মিলিয়ে অণুগল্পের আঙিনায় বইটি পাঠকপ্রিয়তায় বেশ নজর কাড়বে তা বলাই বাহুল্য।🚫
0 মন্তব্যসমূহ