- - - পা ঠ প্র তি ক্রি য়া - - -

স্বপ্নডিঙা

সিক্তা গোস্বামী

প্রকাশক - এবং অধ্যায়

প্রথম প্রকাশ - নভেম্বর ২০২২

প্রচ্ছদ - সুদীপ্ত ভট্টাচার্য

হার্ড বোর্ড বাইন্ডিং 

ISBN 978-93-93637-8

মূল্য - ২২৫/- ভারতীয় মুদ্রা


সিক্তা গোস্বামীর গল্প পড়ে লেখককে হয়তো আমার মতো অনেকেই বলেছিল, মেয়েবেলার কথা দিয়ে স্মৃতিকথা লেখা যায় জানতাম কিন্তু এত পেলবতা মেশানো গল্প লেখা যায় সত্যি জানতাম না। শুধু পেলবতা বললে ঠিক বলা হল না। তারসঙ্গে এক চামচ করুণ সুর, তারসঙ্গে এক চামচ মনের কথা, তারসঙ্গে এক চামচ প্রেম মিশিয়ে গল্পগুলো লিখেছেন সিক্তা গোস্বামী। লেখকের লেখা স্মৃতির পেয়ালাসুতপার গল্প। হারানো রাগিণীলতিকার গল্প। রাঙা ঠাকুমাকেকার গল্প। হৃদয় বৃত্তেকুর্চির গল্প। সুতপা, লতিকা, কেকা, কুর্চির সঙ্গে গল্পগুলো মেয়েবেলারও অথবা সংসারবেলার। সিক্তা গোস্বামীর লেখা আটপৌরে জীবনের এই গল্পগুলো ঠিক যতনা গল্প তার থেকেও বেশী বাস্তব ধরে রাখা টুকরো টুকরো ভালো লাগা, মন্দ লাগা মুহুর্ত।

এতক্ষণ লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ মেয়েবেলার চুপকথা নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করলাম তা সিক্তা গোস্বামীর পাঠক মাত্রই বুঝে যাবে। কিন্তু না, মেয়েবেলার কথা বলেই লেখক চুপ করে যান নি। তাঁর পরবর্তী গল্পগ্রন্থ স্বপ্নডিঙায় লেখক স্বপ্নের ডিঙায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন পাঠককে।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। লেখক সিক্তা গোস্বামী তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ স্বপ্নডিঙার প্রথম গল্প স্বপ্নডিঙায় স্বপ্নিলকে স্বপ্ন বুনতে বুনতে এক অদ্ভুত বাস্তবের মুখে ফেলেছেন। সেখান থেকে স্বপ্নের ডিঙা চেপে স্বপ্নিল ফিরতে পারবে তো তার স্বপ্নের দেশে? নাকি নিজের বিশ্বাস আর শতভিষার বিশ্বাস মিলেমিশে স্বপ্নডিঙা নতুন নদীতে ভাসবে? এই গল্পে শতভিষা নয় স্বপ্নিলকে কেন্দ্র করে লেখকের গল্প পাড়ি দিয়েছে ট্রেনে চেপে শহর থেকে গ্রামে। 

প্রচ্ছদ- সুদীপ্ত ভট্টাচার্য
পরের গল্প মেঘ সরিয়েতে অনুপমা কীভাবে একা নিজের সঙ্গে নিজে লড়ছে তার সুন্দর ছবি অক্ষরে এঁকেছেন লেখক। অপত্যগল্পে মল্লিকার সন্তান আকাঙ্খা গল্পটির অন্য সব চরিত্রগুলিকেই ছুঁয়ে যায়। কিন্তু শেষে এসে লেখক যে পরিণতির সামনে নিয়ে এলেন পাঠকদের তা সত্যিই অভাবিত। সিক্তা গোস্বামী গল্প লেখেন না, উনি গল্প করেন তাঁর পাঠকদের সঙ্গে। ঠিক যেভাবে একজন তার বন্ধুবৃত্তে বসে সংসারের গল্প করে, ছোটোবেলার গল্প করে, ঠিক সেভাবে লেখক ছোটো ছোটো কথা বুনে গল্প বলেন তাঁর বন্ধু পাঠকদের।

এই ব্যালকনিটা নয়নার খুব প্রিয় জায়গা। সামনেই চৌধুরীদের বাগান। আম, জাম, জামরুল গাছ যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে পাখিদের নিপুণ সংসার। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। ওদের ডিম পাড়ার সময় হলে বেশ বোঝা যায়। খড়কুটো এনে ঝটপট বাসা বানায় কর্তা গিন্নীতে। কী ব্যস্ততা তখন। আবার বাচ্ছা ফুটলেই মায়ের চরম ব্যস্ততা। ছানাদের ডানা শক্ত করে যতক্ষণ না সাবলম্বী করে তুলতে পারছে মা আগলে রাখে ওদের। নয়না এইসব দেখে ভুলে থাকতে চায় অনেক কিছু।  (গল্পের নাম বন্ধন’)

বন্ধনগল্পে নয়না ভুলে থাকতে চায় নিজের কথা, নিজের সন্তান না হবার কথা। কিন্তু সত্যি কি ভোলা যায়? যায় না বলেই সে অপলক চেয়ে থাকে পাখির সংসারের দিকে। গাছেদের সংসারের দিকে। তবে নয়নার দুঃখে কাতর না হয়ে লেখক গল্পে জানায় নয়না পায় বুবুকে। শুধু নয়না নয়, মানসেরও বুবুর প্রতি সন্তান স্নেহ ঝরে পড়ে। বুবুর জন্য দুধের বোতল, স্নানের তোয়ালে, পোশাক, খেলনা আরও কত কি এল। শুধু বুবুর মা আর হাসপাতাল থেকে এল না। বুবু কে? তা লেখক পাঠককে প্রথমেই জানিয়ে দেয়। কিন্তু তা জানা সত্ত্বেও পাঠক লেখকের অক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে গল্পে প্রবেশ করে। নয়না আর মানস পুত্র সন্তান লাভ করে, নাম রাখে বাবি। তখন বুবুর অভিমান হয়। অভিমান ক্রমে আক্রোশে পরিণত হয়। নয়না আর মানসের জীবনে বুবু আর বাবিকে ঘিরে সমস্যা ঘনীভূত হয়। সমস্যার সমাধানও হয়। গল্প শেষ হয়। নয়না আর মানস আকুল চোখে দেখতে থাকে একটি সভ্য প্রাণীকে আদিম জগতের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে। হ্যাঁ, সভ্য প্রাণীটি এখানে বুবু নামে হনুমান বা না-মানুষ। চমকে গেলেন কিনা! কিন্তু সিক্তা গোস্বামী পাঠককে চমকাতে এই গল্প লেখেননি। তাই পাঠক প্রথম থেকেই জানতো বুবু আসলে কে? শুধু যা জানতো না তা হল, গল্পের শেষে নয়না আর মানসের সঙ্গে পাঠকও কাঁদবে। খুব ভাল গল্প বন্ধন

কমলা ইঁদুর টার নাম দিয়েছে ছুটকী। কমলা ও সুবলের প্রতি ভয় কাটিয়ে ছুটকী এখন ওদের আপনজন। পরিবারের এই ছোট্ট সদস্যকে নিয়ে ওদের চিন্তা ভাবনার অন্ত নেই। সকালে ওকে চাল, গম বা অন্য কিছু খাইয়ে ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে কমলা কাজে বেরোয়। সারাদিন মন পড়ে থাকে ঘরে। কি জানি! ধেড়ে ইঁদুরগুলো ছুটকীর কোন ক্ষতি করল কি না। ধেড়েগুলো তো এক একটা ডানপিঠে। বড় বড় থালা বাটিও ঝন ঝন করে ফেলে দেয়। যদিও ঝুড়ির ওপর থান ইঁট চাপা দেওয়া থাকে।” ( গল্পের নাম ছুটকী’)

একটা না-মানুষের জন্য এই অপত্য স্নেহ অসম্ভব সুন্দর ভাবে শুধু বন্ধনগল্পে নয় ছুটকীগল্পেও লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। না কুকুর, বেড়াল নয়, একটা ইঁদুর। পোষ্যকে নিয়ে ঘর করে অনেকেই কিন্তু এখানে শখের পোষ্য নয় ছুটকী বা বুবু। যেখানে নয়না আর মানস সন্তান না হবার দুঃখে আঁকড়ে ধরেছেন বুবুকে সেখানে কমলা আর সুবল ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে চলে যাবার পর একাকিত্ব ঘোচাতে আঁকড়ে ধরেছে ছুটকীকে। নুন আনতে পানতা ফুরানো কমলা-সুবলের সংসারে ভালোবাসার অভাব নেই। সবচেয়ে অবাক হতে হয় এই গল্পগুলোয় স্বামী- স্ত্রীর বোঝা পড়া দেখে। না কোনোটাই বানানো নয় তা গল্পের অক্ষরে অক্ষরে বোঝা যায়।  

সিক্তা গোস্বামী শুধু চৈতালী (গল্পের নাম নীলোৎপল’), নিবেদিতা ( গল্পের নাম সময়ের কাছে’) বা গৌরীর (গল্পের নাম টানা পোড়েন’) গল্প লেখেন ভাবলে ভুল হবে। সিক্তা গোস্বামী দেবতোষ (গল্পের নাম আলোর খোঁজে’) বা অশোকের (গল্পের নাম ৫ নং গোধূলি’) গল্পও লিখেছেন। 

আলোর খোঁজেগল্পে দেবতোষ অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন তবু তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে এতটুকু টলছেন না। শেষে কাকে জেতালেন লেখক, দেবতোষের বিশ্বাস না সংস্কার? প্রথম গল্প স্বপ্নডিঙায় স্বপ্নিল কে লেখক যে সুতোয় গেঁথেছেন আলোর খোঁজেগল্পেও ঠিক একই সুতোয় দেবতোষকে গেঁথেছেন। কিন্তু দুটি সুতোর গিঁট আলাদা। তাই লেখক দুভাবে দুটি গল্প পরিণিতির দিকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। এখানেই লেখকের মুন্সীয়ানা। ৫ নং গোধূলিগল্পে অশোক গোধূলীর ৫ নং ঘরের আজীবন আবাসিক হবার জন্য বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাঁর সেই আশায় জল ঢালছেন স্ত্রী ঝর্ণা। অশোকের সেই আশা সত্যি পূরণ হলো কিনা তা গল্প বলবে। আর আমরা সেই গল্প পড়তে পড়তে খুঁজবো এটা কি আদৌ গল্প! গল্পকার মানস সরকার যথার্থই লিখেছেন, নিজের গল্পে সিক্তা গোস্বামী নারীদের পুরুষদের থেকে এগিয়ে রাখেন নি। পিছিয়েও নয়। 

ছোটোবেলায় কারো কারো কাছে আমরা সকলেই শোনা গল্প বার বার শুনতে চাই। এই যেমন আমি আমার ছোটো পিসি এলেই বলতাম, পিসি, সেই গল্পটা বলো নাজানা গল্প শুনতে একটুও একঘেঁয়ে লাগতো না। শুধু আমি নই, আমার মেয়ে এখনো তার মাসি এলেই বলে, মাসি তোমাদের ছোটোবেলার সেই গল্পটা বলো না? সিক্তা গোস্বামীর গল্পও তাই। অনেক কটি গল্প আমি লেখকের মুখে পাঠ করতে শুনেছি। তবু বই পেয়ে আবার পড়ে ফেললাম গল্পগুলি। তার একটাই কারণ সিক্তা গোস্বামী গল্প লেখেন না, গল্প বলেন না, উনি চেনা জগতের চেনা মানুষগুলোকে গল্পে মুড়ে আমাদের পরিবেশন করেন। আর পাঠকমন চেনা মানুষগুলোর দেখা পেয়ে আপন করে নেয় গল্পগুলোকে। গল্পে আর পাঠকে সখ্যতা তৈরি হয়।

যে কথা প্রতিটি গল্প পড়ার পর বলতেই হয় তা হল, লেখকের পরিমিতি বোধ। আর যে সুরে প্রায় প্রতিটি গল্পই বাঁধা আছে তার ঝোঁক অবশ্যই করুণ। করুণ সুরে বাঁধা সিক্তা গোস্বামীর স্বপ্নডিঙার গল্পগুলো চেনা জানা পাঠকমন জয় করে অচেনা পাঠক সমুদ্রের দিকে ভেসে যাবে এই বিশ্বাস রাখি। 

---------------------------------------------------------------------

মৌসুমী ঘোষ


সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। নয়ের দশক থেকে লেখালেখি শুরু। ছোটো গল্পের জন্য বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন 'অনন্ত কুমার সরকার' স্মৃতি পুরস্কার'(২০১৭)। অণুগল্পের জন্য পেয়েছেন গল্প-সল্পের আটচালা আয়োজিত 'উৎপল স্মৃতি পুরস্কার'(২০১৯)। 'মৌসুমী যে অণুগল্পগুলি লিখেছিল' এই নামেই প্রকাশিত প্রথম বই। অণু-পুস্তিকাটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল পাঠকমহলে। প্রথম গল্প সংকলন, 'সোনালি খড়ের বোঝা' (২০২০), যুগ্ম গল্প সংকলন 'যেসব গল্পের কোনোও মানে হয় না' (২০২১), দ্বিতীয় গল্প সংকলন, 'জাঙ্গুলিক'। বর্তমানে মৌসুমী আরেকটি ওয়েব পত্রিকা সম্পাদনা করছেন 'জ্বলদর্চি' পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশিত, ছোটোদের জন্য সাপ্তাহিক ওয়েব পত্রিকা 'ছেলেবেলা'। 


পড়ার জন্য নির্দিষ্ট শিরোনামে ক্লিক করতে হবে

👉২০.০৪.২০২২।। হৃদ মাঝারে...

👉 ৩.০৫.২০২২ ।। পিছাবনী

👉২.০২.২০২৩ ।। গল্পপাখি এবং

👉 ২১.০১.২৩ ।। রোহিণী নক্ষত্রের পতন

👉 ২১.০২.২৩ ।। আপেল

👉 ০৪.০৪.২০২৩।। গল্পসংগ্রহ - বীরেন শাসমল

👉১৫.০৪.২০২৩।। মনভাসি ।। শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় 

👉 ০৯.০৭.২০২৩।। অণুগল্পমেলা ১।। সম্পাদনা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়